২০০৬ সালের ১৯ অক্টোবর পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার নৌবাড়িয়া নতুনপাড়া ঘাটে গোমানী নদীর ওপর একটি সেতুর নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তত্কালীন সংসদ সদস্য (এমপি) কেএম আনোয়ারুল ইসলাম। ‘গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ যোগাযোগ, হাট-বাজার উন্নয়ন ও পুনর্বাসন’ প্রকল্পের আওতায় সেতুটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু বিএনপি সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর আর এগোয়নি সেতুটির নির্মাণকাজ। পরবর্তীতে ২০১২ সালের ১৭ মে দ্বিতীয় দফায় সেতুটি নির্মাণের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি মকবুল হোসেন। এতেও পূর্ণতা পায়নি এ সেতু। এরই মধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে আটবার। আর ঠিকাদার পরিবর্তন করা হয়েছে চারবার। কিন্তু গত ১১ বছরে অর্ধেকও শেষ হয়নি সেতুটির নির্মাণকাজ।
একই প্রকল্পের আওতায় পাবনার ফরিদপুর উপজেলায় দীঘুলিয়া বাজার ভায়া পাঁচ পুঙ্গুলি হাট সড়কের নারায়ণপুর ঘাটে বড়াল নদীর ওপর ১৮০ দশমিক ১২৫ মিটার দীর্ঘ একটি পিসি গার্ডার সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০০৬ সালে। কিছুদিন কাজ করার পর অজ্ঞাত কারণে তা বন্ধ করে দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে চেষ্টা করেও কাজটি শেষ করাতে না পারায় ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জামানত বাজেয়াপ্ত করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এরই মধ্যে ২০১৬ সালে পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন জনগুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ যোগাযোগ, হাট-বাজার উন্নয়ন ও পুনর্বাসন প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে সেতু দুটির নির্মাণ।
সেতু দুটির বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পাবনা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোহা. রেজাউল করিম জানান, সেতুগুলোর কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য তার দপ্তর থেকে সার্বক্ষণিক তদারকি করা হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বর নাগাদ সেতু দুটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার আশা ব্যক্ত করলেও নির্মাণকাজ এত বিলম্বিত হয়েছে কেন, সে সম্পর্কে কিছু বলতে চাননি তিনি।
তবে চাটমোহর-ভাঙ্গুড়া-ফরিদপুরের তত্কালীন এমপি ও বিএনপি নেতা কেএম আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বিএনপির সময় কাজ দুটি আমরা শুরু করেছিলাম। অদৃশ্য কারণে কাজ দুটি আর শেষ হয়নি।
এদিকে দীর্ঘ ১২ বছরেও শেষ হয়নি পঞ্চগড়ের মাগুরা ইউনিয়নের লাখেরাজ ঘুমটি-ধনীপাড়া সড়কে টাঙ্গন নদীর ওপর নির্মাণাধীন সেতুটির কাজ। জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার মুহাম্মদ জমিরউদ্দিন সরকার ২০০৬ সালের ২৪ আগস্ট সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু এর পর আর এগোয়নি এর নির্মাণকাজ।
শুধু গোমানী, বড়াল কিংবা টাঙ্গন নদীর ওপর নির্মাণাধীন সেতুটি তিনটি নয়, সারা দেশে এ রকম শতাধিক সেতু রয়েছে— যেগুলোর নির্মাণকাজ বিএনপি আমলে শুরু হলেও এখনো শেষ হয়নি। কোনো কোনোটির ক্ষেত্রে মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে মূল সেতুর কাজ শেষ করা হলেও নির্মাণ হয়নি সংযোগ সড়ক। ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের কোনো কাজেই আসছে না এসব সেতু।
যোগাযোগ করা হলে অসমাপ্ত রয়ে যাওয়া এসব সেতুর বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি সওজের পরিচালক (সড়ক গবেষণাগার) ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন। তবে কাজ দীর্ঘায়িত হওয়ার পেছনে অর্থ সংকটের পাশাপাশি টেকনিক্যাল সমস্যাও থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি। এলজিইডির সহকারী প্রধান প্রকৌশলী মাহবুব ইমাম মোরশেদ বণিক বার্তাকে বলেন, মূলত ঠিকাদারদের অসততার কারণে সেতুগুলোর কাজ দীর্ঘ সময়েও শেষ হচ্ছে না। ওই সময় দলীয়ভাবে যেসব ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, তাদের কাজে স্বচ্ছতা ছিল না। তবে সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টের কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে দ্রুত যেন কাজ শেষ হয়, সে ব্যাপারেও নজর দেয়া হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপি আমলে শুরু হলেও ১১ বছরেও শেষ হয়নি সুনামগঞ্জের ছাতক ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার দোয়ারাবাজারে সুরমা নদীর ওপর নির্মাণাধীন সেতুটির কাজ। ২০০৪ সালে সেতুটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। পরে ওই বছরের ২৩ আগস্ট সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এর পর সরকারের একটি বিশেষ প্রকল্পের আওতায় ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে শুরু হয় সেতুর নির্মাণকাজ। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেতুর নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়। এতে প্রকল্পটি এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) থেকে বাতিল হয়ে যায়। ২০১০ সালে আবার সেতুটি নির্মাণে কাজ শুরুর জন্য ৫১ কোটি টাকার একটি নতুন সংশোধিত প্রকল্প যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আবার নতুন করে ১১২ কোটি ৯৯ লাখ ৪৯ টাকার প্রকল্প অনুমোদনের জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। গত বছরের অক্টোবর মাসে পরিকল্পিত অ্যাপ্রোচ ও নেভিগেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে সেতু নির্মাণে ১১৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পায়। ওই অনুমোদনের পর এখনো ঝুলে আছে সেতুটির নির্মাণকাজ।
উল্লেখ্য, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) অদূরদর্শী পরিকল্পনা ও ভুল নকশার কারণে সেতুটির দুপাড়ে ৪৫ শতাংশের গার্ডার পিলার নির্মাণে সরকারের গচ্ছা গেছে ৮ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, মূল সেতুর দরপত্র মূল্যায়ন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এটি অনুমোদনের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আগের চারটি পিলারের সঙ্গে নতুন তিনটি পিলার সংযোজন করেই সেতুর কাজ সম্পন্ন হবে। এক মাসের মধ্যে কাজ শুরু হবে। প্রকল্পের দুবছর মেয়াদের মধ্যে নির্মাণকাজ সমাপ্ত করা হবে।
সেতুটির বিষয়ে তত্কালীন স্থানীয় এমপি ও বর্তমান জেলা বিএনপির সভাপতি কলিম উদ্দিন আহমদ মিলন জানান, তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জনগণের দাবির মুখে ছাতক-দোয়ারাবাজার সেতুটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে কাজও শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকেই এর কাজ বন্ধ আছে। এর চেয়ে বেশি আর কিছু জানি না।
সওজের আওতায় বিএনপি সরকারের আমলে সাঘাটা-মহিমাগঞ্জ-গোবিন্দগঞ্জ আন্তঃউপজেলা সংযোগ সড়কে উল্যা নদীর ওপর নির্মাণাধীন উল্যা-সোনাতলা সেতুর কাজ শুরু হয় ২০০১ সালের ১৭ জুন। তিন স্প্যানবিশিষ্ট ওই সেতুটি নির্মাণে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় ১ কোটি ৫৪ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। ওই প্রকল্পের আওতায় সেতুটির ওয়েল ফাউন্ডেশনের দুটি ‘পিয়ার’ এবং দুপাশে দুটি অ্যাবেটমেন্টও নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এর পর দীর্ঘ ১৭ বছরেও সেতুটির কাজ এগোয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের শেষদিকে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার শ্রীকুটা-মুড়ারবন্দ সড়কের খোয়াই নদীর ওপর সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। কয়েক দফায় মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির পর ২০১০ সালে সেতুটির কাজ শেষ হলেও সংযোগ সড়ক নির্মাণ হয়নি। ফলে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ সেতুটি কোনো কাজে আসছে না।
এ বিষয়ে হবিগঞ্জ এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী জাকির হোসেন বলেন, ২০১০ সালের ডিসেম্বরে সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এর আগে মেয়াদ কেন বেড়েছে তা বলতে পারব না। কিন্তু বর্তমান সমস্যা হচ্ছে, সংযোগ সড়কের জায়গাটি সওজ নিয়ে নিয়েছে। তাই এখন তাদের ওপরই নির্ভর করবে এ সেতুর ভবিষ্যত্।
২০০৫ সালে তত্কালীন এমপি আনোয়ারুল আজিমের সুপারিশে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে ঝলম ও হাওড়া এলাকার মধ্যবর্তী স্থানে ডাকাতিয়া নদীর ওপর একটি সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করে এলজিইডি। ২০০৬ সালে মূল সেতুটি নির্মিত হলেও এখন পর্যন্ত নির্মাণ হয়নি এর সংযোগ সড়ক। ফলে ১১ বছর ধরে অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে সেতুটি।
একইভাবে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী পৌরসভায় ছন্দারিয়া খালের ওপর প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুটিও অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। দুপাশে চলাচল উপযোগী সড়ক না থাকায় কোনো কাজেই আসছে না সেতুটি।
জানা গেছে, উপজেলার উত্তর গোমদণ্ডীসহ কয়েকটি অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে সেতুটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এলজিইডি। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। অর্ধযুগ পার করে এর কাজ ঢিমেতালে শেষ হয় ২০১২ সালের দিকে। সেতু নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় আড়াই কোটি টাকা। সেতু নির্মাণ করলেও সড়ক নির্মাণ করেনি এলজিইডি।