সহিংসতা থেকে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে বলে ধারণা করছে জাতিসংঘ। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকায় রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের আসা অব্যাহত আছে। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল হলেও সংখ্যাটা এখন ৩ লাখের ধারেকাছে বলে মনে করছে জাতিসংঘ।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের খাদ্যবিষয়ক সংস্থা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এদেশীয় ভারপ্রাপ্ত পরিচালক দীপায়ন ভট্টাচার্য গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। বাংলাদেশে আসা নতুন রোহিঙ্গাদের সংখ্যার ধারণা কীভাবে করা হচ্ছে জানতে চাইলে দীপায়ন বলেন, প্রতিদিন যেভাবে রোহিঙ্গা আসছে, সে সম্পর্কে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও মানবিক সংস্থার তথ্য পর্যালোচনা করে এই ৩ লাখ রোহিঙ্গার সংখ্যাটি বিবেচনা করা হচ্ছে। তিনি জানান, নতুন আসা রোহিঙ্গাদের জন্য খাবার নিশ্চিত করতে বাড়তি ১১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে ডব্লিউএফপি।
পাশে থাকবে তুরস্ক
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিয়ে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে তুরস্ক। গতকাল সন্ধ্যায় তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোয়ান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। এ সময় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিয়ে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দেন।
বার্তা সংস্থা বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সময় বলেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের এ দেশে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে শুধু মানবিক কারণে। যদিও এটা বাংলাদেশের জন্য বড় বোঝা হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তুরস্কের ফার্স্ট লেডি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়ে এ সময় বলেন, তুরস্ক রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।
কাঁদলেন তুরস্কের ফার্স্ট লেডি
এদিকে গতকাল দুপুরে কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে যান তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এবং দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী। শুরুতেই তাঁরা রোহিঙ্গাদের কাছে নির্যাতনের বর্ণনা শোনেন। তুরস্কের পক্ষ থেকে কয়েকজনের হাতে ত্রাণ তুলে দেন ফার্স্ট লেডি।
এ সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ-দুর্দশা সরেজমিন দেখে কেঁদে ফেলেন ফার্স্ট লেডি। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ যা করছে, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এই মানবিক বিপর্যয় থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে তুরস্ক সব সময় বাংলাদেশের পাশে থাকবে। তিনি আরও বলেন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘের আগামী সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি তুলে ধরবেন।
গতকাল রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো পরিদর্শনের সময় এক মধ্যবয়স্ক রোহিঙ্গা নারী কাঁদতে কাঁদতে তাঁর দিকে এগিয়ে এলে এমিন এরদোয়ান তাঁকে বুকে টেনে নেন। এ সময় ওই নারীকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে তিনি নিজেও কেঁদে ফেলেন। রোহিঙ্গাদের এই বিপদের সময় ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেন তিনি।
এরপর তুরস্কের ফার্স্ট লেডি সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ যা করছে, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এই মানবিক বিপর্যয় থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে তুরস্ক সব সময় বাংলাদেশের পাশে থাকবে। এমিন এরদোয়ান আরও বলেন, ‘আমরা ৩০ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছি এবং আমরা এ বিষয়ে সচেতন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রোহিঙ্গা বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা ও জাতিসংঘের সঙ্গে আলোচনা করছেন। আমরা রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সহয়তা অব্যাহত রাখব।’
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলেন, রোহিঙ্গারা অত্যন্ত অমানবিক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। তুরস্ক রোহিঙ্গাদের সহায়তায় বাংলাদেশের পাশে থাকবে। ভবিষ্যতেও এ সমর্থন অব্যাহত থাকবে।
‘রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের সহমর্মিতা জানাতে এখানে এসেছি’ উল্লেখ করে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গারা নিজ দেশে আক্রমণের শিকার হচ্ছে। তাদের সহায়তা দেওয়া আমাদের প্রয়োজন। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত থাকবে। তুরস্ক এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজে বের করতে চায়।’
বিশ্বজুড়ে নিন্দা অব্যাহত
এদিকে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা দুই সপ্তাহ ধরে অব্যাহত থাকায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে নিন্দা অব্যাহত রয়েছে। আগামী রোববার কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় ওআইসির শিক্ষা ও বিজ্ঞানবিষয়ক সম্মেলন হবে। সেখানে রোহিঙ্গা বিষয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়া দুই সপ্তাহ পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনের আলোচনার সাইডলাইনে রোহিঙ্গা বিষয়ে একটি বৈঠক হবে। যেখানে জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব, সাবেক মহাসচিব কফি আনানসহ বিভিন্ন দেশের শীর্ষ নেতাদের অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফেদরিকো মুঘেরিনি গতকাল এক বিবৃতিতে অবিলম্বে রাখাইনে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে সব পক্ষকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মেনে চলতে বলেছেন। তিনি অবিলম্বে সেখানকার লোকজনের জরুরি মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে ত্রাণকর্মীদের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করতে বলেছেন। রাখাইনের সংকটের কারণে সেখানকার শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানবিক ভূমিকার জন্য বাংলাদেশের প্রতি তিনি সহমর্মিতা জানিয়েছেন। কোনো রকম দেরি না করে আনান কমিশনের সুপারিশ মিয়ানমার সরকারকে বাধ্যবাধকতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন ফেদরিকো মুঘেরিনি।
ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) মহাসচিব ইউসুফ আল ওথাইমান মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্দশা দূর করতে ইইউ ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে আহ্বান জানিয়েছেন। ইইউর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফেদরিকো মুঘেরিনি, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ রাদ আল হোসেইন ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডিকে লেখা আলাদা চিঠিতে তিনি এই আহ্বান জানান।