ঝুঁকিপূর্ণ হলেও প্রাণ বাঁচাতে উত্তাল নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ অব্যাহত আছে। আর এই ঝুঁকিপূর্ণ পাড়িতে প্রতিদিনই নৌকাডুবিতে নাফ নদে লাশের সারি বাড়ছে।
কক্সবাজারের টেকনাফ সমুদ্র উপকূলে গতকাল ভোরে রোহিঙ্গাবাহী আরও দুটি নৌকাডুবির ঘটনায় ১০ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। মুমূর্ষু অবস্থায় এক রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হলেও পরে তার মৃত্যু হয়। ২৯ আগস্ট রাত থেকে এ পর্যন্ত নৌকাডুবির ঘটনায় ৮৫ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়। বুধবার ভোর পর্যন্ত রোহিঙ্গাবাহী ১১টি নৌকা নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ডুবে যায়।মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সহিংস অভিযানের মুখে নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে প্রতিদিনই শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসছে। ঝুঁকিপূর্ণ এই পারাপারে নৌকা ডুবে প্রাণহানি প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। দুই সপ্তাহ ধরে আসা প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গার অধিকাংশই উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন পাহাড়ে আশ্রয়স্থল খুঁজে পেলেও এখনো হাজার হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয়হীন। ফলে টেকনাফ-কক্সবাজার মহাসড়কের ধারেই অবস্থান নিয়েছে হাজারো রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু। উখিয়া বাজার থেকে কুতুপালং বাজার হয়ে হ্নীলা ও টেকনাফের বিভিন্ন স্থানের মহাসড়কেই রাত কাটাচ্ছে তারা। বাঁশ-পলিথিন দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু তৈরি করে নেবে, এই সামর্থ্যও নেই অনেকের। সহায়সম্বলহীন এসব শরণার্থীর একমাত্র ভরসা এখন ত্রাণ। গতকাল সকাল থেকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকার অনেক বিত্তবান লোক শরণার্থীদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে শুকনো খাবার, বিস্কুট, কেক, খাবার পানি ছিল। কেউ কেউ ত্রিপল ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীও দিচ্ছেন। মিয়ানমারে বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) ও সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের মুখে ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ চলছে। গতকালও নতুন করে স্থল ও নৌসীমান্ত দিয়ে অন্তত ১০ হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে জানান পুরনো রোহিঙ্গা ও উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দারা।
৮০০ নৌকায় রোহিঙ্গা পারাপার : নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে প্রতিদিনই শত শত রোহিঙ্গা টেকনাফে আসছে। প্রায় ৮০০ মাছ ধরার নৌকা রোহিঙ্গা পারাপারে জড়িত বলে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, ‘শাহপরীর দ্বীপ, খুরেরমুখ, সাবরাং, মহেশখালিয়াপাড়া, নাইটংপাড়া, বাহারছড়া, বড়ডেইল, শাপলাপুর উপকূল দিয়ে প্রায় ৮০০ নৌকায় রোহিঙ্গারা টেকনাফে ঢুকছে। কিছু জেলে এ কাজে জড়িত। এরা জনপ্রতি ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা করে হাতিয়ে নিচ্ছে। ’ গতকাল সকালে শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়া ও ঘোলারচর এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, স্থানীয় ৫টি নৌকায় করে শতাধিক রোহিঙ্গা এসেছে। নৌকাগুলো সাগরতীরে না ভিড়ে বুকপানিতে রোহিঙ্গাদের নামিয়ে দিচ্ছে। জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও তারা সাগর ও নদী পার হচ্ছে বলে জানান নৌকায় আসা রোহিঙ্গারা।
দ্বিগুণ দামে নির্মাণসামগ্রী বিক্রি : উখিয়া ও টেকনাফের একটি মহল রোহিঙ্গাদের সঙ্গে চড়া দামের ব্যবসা করে যাচ্ছে। অসহায় রোহিঙ্গাদের কাছে একটি বড় বাঁশ বিক্রি করছে ২০০-২৫০ টাকায়। আর লবণ মাঠে এক দফা ব্যবহূত ১৮/৪ ফুটের একটি পলিথিন বিক্রি করা হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়। সাধারণত এসব পলিথিন এর অর্ধেক মূল্যেও বেচা যায় না বলে উখিয়া বাজারের অনেক দোকানদার তথ্য দিয়েছেন। দোকানদার আবদুল মালেক বলেন, ‘এটা অসহায় মানুষের প্রতি চরম জুলুম ও নির্যাতন। তারাও অন্য কোনো উপায় না দেখে চড়া মূল্যে এসব জিনিস কিনে নিচ্ছেন। ’
পানির দরে কেনা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের গরু : সীমান্তের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির আজোহাইয়া, বাইশফাঁড়ি, রেজু আমতলী, ঘুমধুমের পার্শ্ববর্তী পালংখালী এলাকায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসা গবাদিপশু গরু ও ছাগল নামমাত্র মূল্যে কিনে নিতে তত্পর রয়েছে একটি চক্র। এ কাজে কোনো কোনো এলাকায় ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরাও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। সাধারণত যে গরু বাজারে কিনতে লাগবে ৩০-৪০ হাজার টাকা তা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে কেনা হচ্ছে ২০-২৫ হাজারে। আবার অনেক সময় দরদাম করে কিছু টাকা পরে দেওয়া হবে বলেও রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে গরু-ছাগল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া অনেক সময় বিজিবি ও পুলিশের সদস্যরাও রোহিঙ্গাদের গরু-ছাগল কেড়ে নিয়ে নিলামে বিক্রি করছেন। কোরবানি ঈদের দুই দিন আগে পালংখালী বাজারে রোহিঙ্গাদের ১৫২টি গরু মাইকে ঘোষণা দিয়ে নিলামে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
সীমান্তের ওপারে থামছে না রোহিঙ্গা নির্যাতন : মিয়ানমার সীমান্তের ওপার থেকে গতকালও গুলির শব্দ শোনা গেছে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি যদিও বলে যাচ্ছেন, আরাকান রাজ্যে সবাই সুরক্ষিত রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সে দেশে নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতন থামছে না। গতকালও রোহিঙ্গাপাড়া জ্বালিয়ে দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
আটক ৬ : মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবরুদ্ধ করে টাকা আদায়ের অভিযোগে ছয়জনকে আটক করেছে র্যাব। তাদের বিভিন্ন মেয়াদে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বুধবার গভীর রাত থেকে বৃহস্পতিবার ভোর ৫টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শাপলাপুর থেকে তাদের আটক করা হয়। দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন টেকনাফের শাপলাপুরের জুবায়ের হেলাল, একই উপজেলার মহেশখালিয়াপাড়ার আবুল কাশেম, বড় ডেইল গ্রামের জালাল উদ্দিন, লেঙ্গুর বিল গ্রামের মোস্তাক মিয়া, শাপলাপুর গ্রামের কালা মিয়া ও সৈয়দ আলম।
নাফ নদে জন্ম, ঝুপড়িতে আশ্রয় : প্রথম দেখায় মনে হবে ভ্রাম্যমাণ কোনো বিক্রেতা। আসলে তারা মিয়ানমারের সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা দম্পতি। ঝুড়িতে কাপড়ে ঢাকা এক নবজাতক। সাত দিন আগে নাফ নদে নৌকার ওপরে এই শিশুর জন্ম। নবজাতকসহ পিতা-মাতা অনেক কষ্ট করে গতকাল আশ্রয় নিয়েছেন কুতুপালং রাস্তার পাশে এক ঝুপড়িতে। পাঁচ দিন ধরে না খেয়ে আছে তারা। শিশুটির পিতা জানান, ‘কোরবানি ঈদের দিন রাত ১২টার দিকে নাফ নদে নৌকার ওপর আমার স্ত্রীর প্রসবযন্ত্রণা শুরু হয়। তখন নৌকায় মাত্র একজন নারী ছিলেন। বাকিরা পুরুষ। তখন চোখে কিছু না দেখে আমি নিজেই সহযোগিতা করি আমার স্ত্রীকে। ’ নবজাতকের মা খালেদা বেগম বলেন, ‘এটি আমার প্রথম সন্তান। সন্তানটি ছেলে। এখনো নাম রাখিনি। যেহেতু কোরবানির দিন জন্ম হয়েছে, তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি কোরবান আলী নাম রাখব। ’ হাসিমুখে তিনি জানান, সন্তানের চেহারা দেখে মিয়ানমারের সেই করুণ স্মৃতি তিনি ভুলে গেছেন। গত পাঁচ দিন তারা স্বামী-স্ত্রী পানি ছাড়া কিছুই খাননি বলে জানান।