তার উপর দেখা দিয়েছে সীমাহীন খাদ্য ও স্বাস্থ্য সংকট। পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে ইতিমধ্যে নারী ও শিশুদেও বড় একটি অংশ অপুষ্টিতে ভোগতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন শিবিরে স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা এনজিও কর্মকর্তারা।রেড ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থা রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা দিলেও তা পর্যাপ্ত নয়। খাদ্যাভাবে অনেক রোহিঙ্গাই অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন। এদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
সরেজমিনে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং ও বালুখালী এবং টেকনাফের ল্যাদা ও মুছনী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা বস্তি ঘুরে দেখা গেছে, প্রাণের টানে এপারে আশ্রয় নিতে আসা রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবন যাপনের এ করুণ চিত্র।
সহায় সম্পদ, আত্মীয় স্বজন হারিয়ে রোহিঙ্গারা কোন রকমে বাঁচার আশায় আশ্রয় নিয়ে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছে। গরমের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের মাঝে দেখা দিয়েছে খাদ্য অভাব। নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য কয়েকটি এনজিও প্রথম দিকে ত্রাণ সামগ্রী দিলেও নানা সমস্যার কথা বলে ওই সব এনজিও গুলোও গা ডাকা দিয়েছে। এখন আশপাশের বিত্তশালী ও দূর-দূরান্তের স্বেচ্ছাসেবীদের দেওয়া ত্রাণই ভরসা রোহিঙ্গাদের।
বালুখালীসহ বিভিন্ন বনভূমিতে বসবাসরত নতুন আসা প্রায় দেড় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা খাদ্য সংকট ও তীব্র গরমে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। কাজের সুযোগ নাথাকায় তাদের অধিকাংশই বেকার বসে আছে। কোন শিবির বা রোহিঙ্গা বস্তিগুলোতে আশ্রয় মিলছে না বলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা এই জনপদেও সড়ক-মহাসড়ক ও বনভূমিতে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে।
এদিকে মিয়ানমারে দমন-পীড়ন ও চরম নির্যাতনের মুখে যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন, কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালিতে বনবিভাগের ৫০ একর জমিতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করছে জেলা প্রশাসন।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, গতবছর অক্টোবরে রাখাইনে সহিংসতার পর রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ শুরু হলে উখিয়ার বালুখালিতে বনবিভাগের ওই জমি বরাদ্দ দেওয়া হয় মাস ছয়েক আগে। গত বছর আসা কয়েক হাজার রোহিঙ্গা সেখানে আছে। নতুন করে যারা আসছে, তাদেরও সেখানে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হবে।
খালেদ মাহমুদ বলেন, নতুন আসা রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থেকে ওই ক্যাম্পের আশেপাশে থাকতে বলা হয়েছে। এখানে কাউকে বাধা দেওয়া হবে না। অন্য কোথায়ও থাকলে তাদের উচ্ছেদ করা হবে।
গত ২৪ অাগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে পুলিশ পোস্ট ও সেনাক্যাম্পে হামলার পর থেকেই বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গাদের এই ঢল।
গত কয়েক দিন ধরে উখিয়ার কুতুপালং থেকে শুরু করে থাইংখালী পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পাহাড়ে পাহাড়ে বাঁশ আর পলিথিনের অসংখ্য ঝুপড়ি গড়ে তুলেছে তারা। রোহিঙ্গাদের নতুন বসতি দেখা গেছে টেকনাফ সীমান্তবর্তী হোয়াইক্যং ইউনিয়ন, ল্যাদা ও মুছনী ক্যাম্পসহ আশপাশের এলাকাতেও।
উখিয়ার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা আলমগীর আলম মিনা বলেন, শরণার্থীর অনুপ্রবেশ থামছে না। তবে এখন দেখা দিয়েছে খাদ্যসংকট। অপুষ্টিতে ভোগার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনেক রোহিঙ্গা নারী ও শিশু।
তীব্র গরমের মধ্যে পলিথিনের একটি ঝুঁপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে বসবাস করছে ৭-১০ জনের একেকটি পরিবার। তেমনি একটি পরিবারের সদস্য আবদুর রহমান জানায়, দিনের বেলায় তাদের ঘরের ভেতরে যেন আগুন জ্বলছে। তাই দিনের বেলায় আশপাশের গাছ গাছালির নিচে তারা আশ্রয় নিচে আশ্রয় নিয়ে থাকে। কেউ কোন কিছু দিলে তা খেয়েই চলছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা প্রতিদিনই আসছে। তারা যেভাবে পাহাড়ের যত্রতত্র আশ্রয় নিচ্ছে, তাতে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ আগস্ট মধ্যরাতের পর রোহিঙ্গা যোদ্ধারা অন্তত ২৫টি পুলিশ স্টেশন ও একটি সেনাক্যাম্পে প্রবেশের চেষ্টা করলে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। এরপর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হেলিকপ্টার গানশিপের ব্যাপক ব্যবহার করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এতে মিয়ানমার সরকারের হিসাবে ৪ শতাধিক রোহিঙ্গা মুসলিম নিহত হয়েছেন। সংঘর্ষে আহত শত শত রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু বাংলাদেশে এসেছেন।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন ইউএনএইচসিআর’র সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এক লাখ ২৩ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে।
অন্যদিকে মিয়ানমারে চলছে রোহিঙ্গা নির্যাতন, সীমান্তে মাইন বিষ্ফোরণ: মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। উখিয়ার বালুখালী ও তমব্রুর বাইশপারি সীমান্তে মাইন বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে দুই রোহিঙ্গা গুরুতর আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া সীমান্তের আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গা পাড়াগুলোতে দফায় দফায় আগুন ও ধোঁয়ার কুন্ডলি প্রত্যক্ষ করা গেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে ঘুমধুম বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায় লে. কর্নেল মনজুরুল হাসান খান বলেন, মাইন বিষ্ফোরণের ঘটনা সম্পকে আমরাও শুনেছি। তবে এটা মিয়ানমারের ভিতরেই ঘটেছে, তাই আমার কোন মন্তব্য করা সমীচিন হবে না।