বাংলাদেশে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল অব্যাহত রয়েছে। এক পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারের দিকে ঠেলে দেয়া হলেও অন্য পয়েন্ট দিয়ে আবারো বাংলাদেশ সীমানায় চলে আসছে তারা। আশ্রয় নিচ্ছে উখিয়া উপজেলার কুতুপালং, বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন স্থানে। জাতিসংঘের হিসাবে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর গত ১০ দিনে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা। আরো প্রায় ২০ হাজার মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে বলে এএফপির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
নতুন করে আসা হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর চাপে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শরণার্থী শিবিরগুলো হিমশিম খাচ্ছে। টেকনাফ ও কক্সবাজারে শত শত অস্থায়ী ছাউনির নিচে শরণার্থীরা মাথা গোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছে। গত কয়েক দিনে বাংলাদেশে প্রবেশে কাউকে বাধা দেয়া হয়নি বলে সীমান্ত পেরিয়ে আসা মানুষের বরাতে জাতিসংঘ জানিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কক্সবাজার ক্যাম্পের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মনজুর আহসান খান বণিক বার্তাকে বলেন, কিছু রোহিঙ্গা প্রবেশ করছে। তবে তারা কেউই আমাদের সামনে দিয়ে আসছে না। স্থানীয়দের সহায়তায় সীমান্ত অতিক্রম করে তারা বাংলাদেশে আসছে। স্থানীয়রা ওইসব রোহিঙ্গাকে নিজেদের স্বজন হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। এখানকার পরিস্থিতি এতটাই মানবিক যে, সবকিছু দেখার পর আর কিছু করার থাকছে না।
রাখাইন প্রদেশে অত্যধিক বলপ্রয়োগ ও রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের জন্য মিয়ানমার সরকার এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে পড়েছে। সংকট নিরসনে আরো পদক্ষেপ নেয়ার চাপ দিতে গতকাল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং লাইংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু রাখাইন প্রদেশে সংকটের স্থায়ী সামাধানের বিষয়ে চলতি বছর একটি সম্মেলন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন। এর আগে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ করেন।
মিয়ানমারের নেত্রী সু চির কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে রাখাইন প্রদেশে সে দেশের সেনাবাহিনীর নেয়া পদক্ষেপগুলোকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ বলে অভিহিত করে তাদের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য দায়ী করা হয়েছে। এজন্য মিয়ানমার সরকারের সমালোচনা করেছে ব্রিটেন। জাতিসংঘে ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, সরকারের উসকানিমূলক বক্তব্য রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও সাহায্যকর্মীদের বিষয়ে বিরূপ জনমত সৃষ্টি করছে। ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত অং সান সু চিকে ‘যথাযথ কথা বলার’ আহ্বান জানিয়েছেন। সু চিকে সতর্ক করে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি চলমান আচরণ মিয়ানমারের দুর্নামের কারণ হচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বর্বরতার বিষয়ে নীরব থাকায় সু চির আরো সমালোচনা করেছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, আমি এখনো রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতার সমালোচনা করে আমারই মতো আরেক নোবেলজয়ী অং সান সু চির বিবৃতির অপেক্ষায় রয়েছি।
গতকাল এক বিবৃতিতে মালালা ইউসুফজাই আরো বলেন, আশা করছি, আমার দেশ পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশ বাংলাদেশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে এবং সহিংসতা ও আতঙ্ক থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অন্ন, আশ্রয় ও শিক্ষার সুযোগ দেবে।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলো জ্বালিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। স্যাটেলাইট থেকে সংগৃহীত ছবির সূত্রে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১৭টি পৃথক স্থান চিহ্নিত করেছে, যেখানে কোথাও কোথাও পুরো গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কেবল রাখাইন প্রদেশের মুসলিম অধ্যুষিত রাথিদং এলাকাতেই ৭০০ বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।
রাখাইন প্রদেশে সহিংসতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আরাকান প্রজেক্টের পরিচালক ক্রিস লেওয়া বলেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পাশাপাশি সে দেশের কিছু লোকও গণহত্যায় অংশ নিচ্ছে। নৃশংসতার প্রমাণ লুকাতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মরদেহ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের নিউজডে অনুষ্ঠানে গতকাল তিনি এসব কথা বলেন।
ব্যাংককভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটস বলেছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা শিশুদের জবাই করে হত্যা করছে এবং জীবন্ত মানুষকেও পুড়িয়ে ফেলছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যাওয়া দুই ডজন মানুষের দেয়া সাক্ষাত্কারের ভিত্তিতে ফরটিফাই রাইটস এ অভিযোগ করেছে।
এদিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান ‘অভিযান’ অব্যাহত রাখার আভাস দিয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং লাইং বলেছেন, রোহিঙ্গা গ্রামগুলোয় চলমান অভিযান হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের ‘অসমাপ্ত কাজ’। তিনি বলেন, মিয়ানমারের সীমান্ত সুরক্ষা এবং রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যাতে নিজেদের ভূখণ্ড গড়ে তুলতে না পারে, তা ঠেকাতে সেনাবাহিনী দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন করছে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রধান ১৯৪২ সালে রাখাইন প্রদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, সে সময় জাতিগত রোহিঙ্গারা পলায়নপর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। অন্যদিকে রোহিঙ্গারা জাপানি বাহিনীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। সেবার পৃথক রোহিঙ্গা রাষ্ট্র গড়ার চেষ্টা চালাতে গিয়ে বেশ কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। মিয়ানমার সেনাবাহিনী প্রধান বলেন, আমরা আর কখনো এত খারাপ ঘটনা ঘটতে দেব না।
এদিকে সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের ভূখণ্ডে গতকাল শক্তিশালী দুটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। বেলা ২টা ২৫ মিনিটে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৫০ মিটার দূরে একটি বিস্ফোরণের ঘটনায় রোহিঙ্গা শরণার্থী এক নারীর পা উড়ে যায়। শরণার্থীদের ব্যবহূত পায়ে চলা পথে এ বিস্ফোরণ ঘটে। আহত নারীকে চিকিত্সার জন্য বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়েছে। অনুপ্রবেশরোধী মাইনে (অ্যান্টি পারসোনেল মাইন) পা ফেলায় তিনি আহত হন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিস্ফোরণস্থলে গিয়ে একজন শরণার্থী যে ছবি এনেছেন, তা দেখেও স্থলমাইন মনে হচ্ছে। সীমান্তের কাছে এমন আরো মাইন থাকতে পারে বলে ওই শরণার্থীর বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে।
বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ আগে ওই এলাকায় মিয়ানমার সৈন্যদের দেখা গেছে বলে শরণার্থীরা জানায়। তবে মাইন পাতার সঙ্গে মিয়ানমার বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির মুখপাত্র জ তাই বলেছেন, কারা মাইন পেতেছে, সে সম্পর্কে আগে নিশ্চিত হতে হবে। সন্ত্রাসীরা নিজেরাই যে মাইন পাতেনি, সেটা নিশ্চিত হতে হবে।