মেশিন বেচে মজুরি পরিশোধের দাবি বিজিএমইএর

Slider জাতীয়

 

মেশিন বেচে মজুরি পরিশোধের দাবি বিজিএমইএর

টঙ্গীর টেক্সটেক পোশাক কারখানার শ্রমিক সংখ্যা ৬০০। কারখানার তিন মালিকের মধ্যে একজন হংকংয়ের, একজন চীনের ও অন্যজন ভারতের। চীন ও হংকংয়ের দুই মালিক বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় ভারতীয় মালিক একা শ্রমিকের প্রাপ্য পরিশোধ করতে পারছিলেন না। এ অবস্থায় কারখানার মেশিন বিক্রি করে শ্রমিকদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।

বিজিএমইএর দাবি, প্রতি বছর ঈদে দু-একটি কারখানার ক্ষেত্রে মেশিন বিক্রি করে শ্রমিকের প্রাপ্য পরিশোধের ঘটনা ঘটে। এবারো তাই হয়েছে। শিল্প পুলিশও এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

সম্প্রতি এ রকম আরেকটি ঘটনা ঘটেছে মিরপুরের মেরিডিয়ান নামে একটি প্রতিষ্ঠানে। কর্তৃপক্ষের শ্রমিক ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্তের জেরে কারখানাটিতে শ্রম অসন্তোষ দেখা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে একই মালিকের স্বত্বাধীন দুটি কারখানা মেরিডিয়ান ও মেগাস্টারের শ্রমিকদের গত বুধবার জুলাই ও আগস্টের ১০ দিনের বেতন বাবদ মোট ২৭ লাখ টাকা বিজিএমইএর সমঝোতায় পরিশোধ করা হয়। এজন্য কারখানাটির মেশিন বিক্রি করতে হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, প্রতি ঈদের আগে এক-দুটি কারখানার মেশিন বিক্রি করে শ্রমিকের পাওনা বুঝিয়ে দেয়া হয়। এবারো তাই হয়েছে। এত বড় খাতে দু-একটি কারখানায় সমস্যা হতেই পারে। আমাদের হাতে বেতন-ভাতা পরিশোধ বিষয়ে সমস্যা সমাধান হয়নি, এমন একটি কারখানাও নেই। তবে সংগঠনের সদস্য নয়, এমন কারখানার দায়িত্ব আমরা নিতে চাই না।

পোশাক শ্রমিকদের ২৪ আগস্টের মধ্যে উত্সব ভাতা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শিল্প মালিকরা। যদিও সে প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি তারা। এ নিয়ে কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন কারখানায় অস্থিরতাও দেখা দেয়। তবে কিছুটা দেরি হলেও সংগঠনের সদস্য প্রায় শতভাগ কারখানায় বেতন-ভাতা পরিশোধ হয়েছে বলে দাবি বিজিএমইএর।

সংগঠনটি বলছে, প্রায় শতভাগ কারখানায় উত্সব ভাতা ও জুলাইয়ের বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। এছাড়া শ্রমিকদের সঙ্গে সমঝোতা করে আগস্টের অগ্রিম বেতন কারখানাভেদে পূর্ণ বা আংশিক প্রদান করা হয়েছে বলেও জানায় সংগঠনটি। তাদের দাবি, ৯০ শতাংশ কারখানায় কর্মীদের ঈদের ছুটি দেয়া হয়েছে আগেই। আর গতকাল বাকি কারখানাগুলোর শ্রমিকরাও ছুটি পেয়েছেন।

তবে বেতন-বোনাস নিয়ে কিছু কারখানায় শ্রম অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। এমনই একটি কারখানা হলো গাজীপুরের হোতাপাড়ার সিলভার কম্পোজিট। কারখানাটিতে শ্রমিক সংখ্যা ২ হাজার ২০০। আগস্টের ১০ দিনের বেতন দিতে চেয়েছিল মালিকপক্ষ। কিন্তু শ্রমিকরা এ সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ভাংচুরও হয় কারখানাটিতে। পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

শ্রম অসন্তোষ দেখা দেয় গাজীপুরেরই আরেকটি কারখানা চন্দ্রার নায়াগ্রাতেও। এ কারখানায় প্রায় ৪ হাজার ৩০০ শ্রমিক রয়েছেন। মালিকপক্ষ ৭৫ শতাংশ শ্রমিককে আগস্টের মজুরি দেয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত জানালে বৈষম্যমূলক এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শ্রমিকরা। পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপে বিষয়টি মীমাংসা করা হয়।

গতকাল বিকালে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দেশের শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় বেতন-ভাতা পরিশোধ প্রক্রিয়া চলমান ছিল। ন্যায্য প্রাপ্য পরিশোধে মালিকদের গড়িমসি আর আদায়ের বিড়ম্বনা মোকাবেলা করেই বাড়ি ফিরছিলেন শ্রমিকরা।

ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনার শিল্পাঞ্চলে সব খাত মিলিয়ে কারাখানা রয়েছে সাড়ে ছয় হাজারেরও কিছু বেশি। এর মধ্যে পোশাক কারখানা রয়েছে ৩ হাজার ২৭৮টি। বাকিগুলো অন্যান্য খাতের। গতকাল বিকাল পর্যন্ত শিল্প পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী বেতন-বোনাস পরিশোধ প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দেশের শিল্প-কারখানায় শতভাগ বেতন-বোনাস পরিশোধের আশা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. নওশের আলী বণিক বার্তাকে বলেন, শতভাগ বেতন-বোনাস পরিশোধ হয়েছে, এমনটা দাবি করা যায়। কারণ এবার বড় কোনো সমস্যা হবে না, এমনটা আশা করেছিলাম এবং তা হয়নিও। তবে গাজীপুরে চার-পাঁচটি ও আশুলিয়ায় দু-তিনটি কারখানায় সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া চলমান। টেক্সটেক, সিলভার কম্পোজিট, নায়াগ্রার মতো কারখানায় শ্রম অসন্তোষের বিষয়ে তিনি বলেন, এত বড় শিল্পে দু-একটি ঘটনা অস্বাভাবিক না।

‘শিল্প পুলিশ-১ ঢাকা’র আওতায় রয়েছে আশুলিয়া, সাভার, ধামরাই এলাকায় মোট ১ হাজার ৭৩টি কারখানা। এর সিংহভাগই বস্ত্র ও পোশাক খাতের। গতকাল বিকাল পর্যন্ত এ শিল্পাঞ্চলে তিন-চারটি কারখানা ছাড়া বাকি সবগুলোয় বেতন-বোনাস পরিশোধ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

‘শিল্প পুলিশ-২ গাজীপুর’-এর আওতায় রয়েছে ১ হাজার ৮০০টির বেশি কারখানা। বেতন-বোনাস নিয়ে অসন্তোষের আশঙ্কা ছিল ১৩২টি কারখানায়। এর মধ্যে ১৩টি বাদে অন্য সবই পোশাক খাতের। গত ৩০ আগস্ট শেষে ৭২ শতাংশ কারখানায় বেতন-বোনাস পরিশোধ হয়েছিল। ছুটি ঘোষণা হয় ৫৫০টি কারখানায়। গতকাল বিকালে শতভাগ কারখানায় বেতন-বোনাস পরিশোধের আশা করছিল গাজীপুর শিল্প পুলিশ। তবে বড় ধরনের সমস্যা হয় তিনটি কারখানায়। তুলনামূলক ছোট কারখানা নিয়ে সমস্যাও মোকাবেলা করতে হয়েছে শিল্প পুলিশকে।

১ হাজার ৮টি কারখানা রয়েছে ‘শিল্প পুলিশ-৩ চট্টগ্রাম’-এর আওতায়। এর মধ্যে ৬৫টিতে অসন্তোষ হতে পারে বলে আশঙ্কা ছিল শিল্প পুলিশের। এ ৬৫টি কারখানার মধ্যে ছয়টি বাদে অন্যগুলো পোশাক শিল্পের। গতকাল পর্যন্ত পোশাক ও অন্যান্য খাত মিলিয়ে এ অঞ্চলের প্রায় শতভাগ কারখানায় কোনো ধরনের সমস্যা ছাড়াই শ্রমিকের প্রাপ্য পরিশোধ হয়। তবে আগস্টের বেতন কোনো কারখানায় ৫০ শতাংশ আবার কোনো কারখানায় ২০ শতাংশ পরিশোধ করা হয়েছে।

‘শিল্প পুলিশ-৪ নারায়ণগঞ্জ’-এর আওতায় রয়েছে ২ হাজার ৪৪২টি কারখানা। এ অঞ্চলের ৭২টি কারখানায় শ্রম অসন্তোষের আশঙ্কায় ছিল পুলিশ। এর মধ্যে ৫১টি কারখানাই পোশাক খাতের। গতকাল বিকাল পর্যন্ত এ অঞ্চলের শিল্প পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ৯০ শতাংশ কারখানায় বেতন-বোনাস পরিশোধ হয়েছে বলে জানায় তারা। এসব কারখানায় জুলাইয়ের বকেয়া শতভাগ পরিশোধ হলেও আগস্টের মজুরি পরিশোধ হয়েছে আংশিক। আর প্রায় ১০০ কারখানা আছে, যেখানে উত্সব ভাতা শ্রমিকের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতেই পরিশোধ করা হয়।

ন্যাশনাল গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, দু-একটি সমস্যা ছাড়া সব কারখানাতেই শ্রমিকের বেতন-বোনাস পরিশোধ হয়েছে। তবে আগস্টের বেতন ও উত্সব ভাতা সমঝোতার ভিত্তিতে আংশিক পরিশোধ করা হয়েছে।

শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারাও বেতন-বোনাস পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে। গতকাল বিকালে অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কর্তৃপক্ষ জানায়, বোনাস পরিশোধ হয়েছে ৯৬ শতাংশ কারখানায়। আর আগস্টের মজুরি পরিশোধ হয়েছে ৭২ শতাংশ কারখানায়। ঢাকা জেলার আওতায় পোশাক কারখানা আছে ১ হাজার ১৯২ আর অন্যান্য কারখানা আছে ৩ হাজার ৪৯৫টি।

ডিআইএফই গাজীপুর কার্যালয় জানায়, ৯৯ শতাংশ কারখানায় বেতন-বোনাস পরিশোধ হয়েছে। গাজীপুর কার্যালয়ের আওতায় পোশাক কারখানা রয়েছে ১ হাজার ৪০০ ও বাকি প্রায় ১ হাজার ৬০০ কারখানা অন্যান্য খাতের। নারায়ণগঞ্জ কার্যালয় থেকে জানানো হয়, ওই এলাকায় মোট কারখানা আছে ৩ হাজার ৮৫০টি। এর মধ্যে পোশাক খাতের ৩৫০টি। বাকি কারখানা অন্যান্য খাতের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *