মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশ সীমান্তে জড়ো হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অন্তত ছয় হাজার মানুষ। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এ কথা জানিয়েছে। গত দুদিনে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় ৪৬৮ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। সোমবার দিবাগত রাতে জল ও স্থলসীমান্ত অতিক্রম করে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। গতকাল সকালে নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে এসব রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয়।
টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম বলেন, সোমবার রাত ও মঙ্গলবার সকালে নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে জলসীমানা অতিক্রম করছিল প্রায় ৪৬৮ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু। সীমান্তে টহলরত বিজিবির সদস্যরা তাদের আটক করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছেন। ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গাকে আটকের পর মানবিক সহায়তা দিয়ে বিজিবি স্বদেশে ফেরত পাঠিয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
অসমর্থিত একটি সূত্র দাবি করেছে, অনুপ্রবেশের আশায় সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ৩০-৩৫ হাজার পর্যন্ত হতে পারে। সহিংসতা থেকে বাঁচতে অনেকে বিভিন্ন পাহাড় ও বনে লুকিয়ে রয়েছে। ফেরত যেতে বাধ্য হওয়ার ভয়ে এরা সরাসরি সীমান্ত অতিক্রমেরও সাহস পাচ্ছে না।
সীমান্তে অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গারা অভিযোগ করে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গণহারে তরুণদের আটক করে নিয়ে যাচ্ছে। যাদের ধরতে পারছে না, তাদের গুলি করা হচ্ছে। বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে সব পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
রাখাইন রাজ্যের ঢেঁকিবুনিয়া উত্তরপাড়ার খালেদ হোসেন জানান, রোববার খুব ভোরে সেনাবাহিনীর একটি দল গ্রামে ঢুকে স্থানীয় জহির, করিম ও আব্দুর শুক্কুরকে আটক করে নিয়ে যায়। এ সময় তারা পালিয়ে পাশের পাহাড়ে আশ্রয় নেন। ঢেঁকিবুনিয়া পূর্বপাড়ার আবছার কামাল জানান, সেনাবাহিনী বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি চালাচ্ছে। কাউকে না পেলে তারা ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মঙ্গলবার সকালে উখিয়ার পালংখালী আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়া আহমদ শফি জানান, ফকিরপাড়ায় দুদিন ধরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রকাশ্যে অনেককে হত্যা করেছে।
উখিয়ার কুতুপালং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য বখতিয়ার আহম্মদ বলেন, নাফ নদী পার হয়ে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নদীর পারে অবস্থান করছে। ওপারে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছি। নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রোববার সন্ধ্যার পর থেকেই থেমে থেমে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সীমান্তের ওপারে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে।
এদিকে মিয়ানমারে গুলিবিদ্ধ সাতজন ও পুড়ে যাওয়া দুজন রোহিঙ্গাকে উন্নত চিকিত্সার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অগ্নিদগ্ধ নুরুল হাকিম (২৬) ও পারভেজকে (২০) রোববার রাত সাড়ে ১১টার দিকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ।
গুলিবিদ্ধরা হলেন— মামুনুর রশিদ (২৭), সাকের (২৭), সাদেক (২০), জাহেদ (২০), নুরুল আলম (১৫), আবুল কাসেম (২০) ও নুরুল আমিন (২২)। সোমবার দিবাগত রাত ২টার দিকে তাদের হাসপাতালে আনা হয়। এর আগে রোববার সকালে চমেকে আনা হয় আরো চার রোহিঙ্গাকে। তারা হলেন— জিয়াবুল (২৭), মো. ইলিয়াছ (২০), মো. তোহা (১৬) ও মোবারক হোসেন (২৫)। এ পর্যন্ত মোট ২২ জন গুলিবিদ্ধ ও দগ্ধ রোহিঙ্গাকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদের মধ্যে মুসা নামে একজন শনিবার চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান।
চমেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির উপসহকারী পরিদর্শক (এএসআই) মো. আলাউদ্দিন তালুকদার জানান, আহতদের কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প হাসপাতালে চিকিত্সা দেয়া হয়েছে। এর পর উন্নত চিকিত্সার জন্য চমেকে নিয়ে আসা হয়। তাদের কক্সবাজার জেলা পুলিশের পাহারায় রাখা হয়েছে।
চিকিত্সকদের বরাত দিয়ে তিনি আরো বলেন, আগুনে ঝলসে যাওয়া দুজনকে বার্ন ইউনিটে চিকিত্সাসেবা দেয়া হচ্ছে। তাদের শরীরের ৫০ শতাংশ পুড়ে গেছে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের নিন্দা
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেজ মিয়ানমারে চলমান সহিংসতায় বেসামরিক প্রাণহানির ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন। মহাসচিবের মুখপাত্র স্টেফান ডুজারিক এ কথা বলেছেন। খবর রয়টার্স।
এক বিবৃতিতে স্টেফান ডুজারিক বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছেন। সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের সময় বেসামরিক নাগরিক হত্যার ঘটনায় তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের প্রতি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সংস্থার মুখপাত্রের বিবৃতিতে বলা হয়, জাতিসংঘ মহাসচিব মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে উদার আশ্রয় দানের কথা স্মরণ করেছেন। তিনি সংশ্লিষ্টদের প্রতি নিরাপত্তার খোঁজে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেয়ার আবেদন জানিয়েছেন।
জাতিসংঘ মুখপাত্র বলেন, পালিয়ে আসা মানুষের অনেকেই নারী ও শিশু। জাতিসংঘ মহাসচিব মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলোকে বিপন্ন মানুষের সাহায্যার্থে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ উভয়কে সব ধরনের প্রয়োজনীয় সাহায্য দিতে জাতিসংঘ প্রস্তুত রয়েছে।
মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেজ রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার মূলোৎপাটনে জোরারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, বিপন্ন মানুষকে সহায়তা এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব মিয়ানমারের ঘাড়েই বর্তায়।
এদিকে মালয়েশিয়া সরকার মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির প্রতি রোহিঙ্গা সংঘাত নিরসন এবং মিয়ানমারের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানিয়েছে। মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী ডক্টর আহমাদ জাহিদ হামিদি বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার পর সু চিকে অবশ্যই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নিতে এবং নিজের নামকে প্রশ্নমুক্ত করতে হবে।
মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বারবার সতর্কতা বার্তা দিয়েছে। জাতিসংঘ, ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) ও মুসলিম দেশগুলো রোহিঙ্গাদের সহায়তা জুগিয়ে গেছে। কিন্তু সমস্যা রয়েই গেছে।
তিনি আরো বলেন, মালয়েশিয়া নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল দেখতে চায় না। আমরা আশা করি, ধর্মের ভিত্তিতে কোনো রকম দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন না করে মিয়ানমার বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করবে।