নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে গত তিনদিনে তিন হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) গতকাল এ কথা জানিয়েছে। এদিকে টানা চতুর্থ দিনের মতো গতকাল সোমবারও রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন প্রদেশে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অভিযান অব্যাহত ছিল।
ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, নতুন করে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগ নারী ও শিশু। সংস্থাটির মুখপাত্র জোসেফ ত্রিপুরা বলেন, ইউএনএইচসিআর ও অন্যান্য জাতিসংঘ সংস্থার হিসাবমতে, তিন হাজারের বেশি ‘নবাগত’ রোহিঙ্গাকে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরের ভেতর ও আশপাশে দেখা গেছে।
মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী রয়টার্সকে জানিয়েছে, রাখাইন প্রদেশে তারা পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাচ্ছে। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে কয়েক মাইল দূরের বুথিদং শহরে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা তুন লাং রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বলেন, পরিস্থিতি এখন ভালো নয়। সবকিছু তাদের ওপর নির্ভর করছে। তারা যদি সক্রিয় থাকে, তাহলে পরিস্থিতির অবনতি হবে।
পুলিশের এ কর্মকর্তা আরো বলেন, আমরা দুভাগে ভাগ হয়ে কাজ করছি। একটি দল পুলিশ ক্যাম্পের নিরাপত্তা দেবে, অন্য দলটি সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্লিয়ারেন্স অপারেশনে যাবে। মিয়ানমার পুলিশের বরাতে স্থানীয় এক সাংবাদিক জানান, বুথিদংয়ের উত্তরে তিনটি পুলিশ ক্যাম্প রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা অবরুদ্ধ রয়েছে।
বুথিদংয়ের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে আরো কাছের শহর মংডু। কক্সবাজারের উখিয়া থেকে হাঁটাপথে ১ ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত মংডুতে রোববার থেকে অনেক বাড়িঘরে আগুন জ্বলছে বলে স্থানীয় সংবাদদাতা ও সেনা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
মংডুর কেয়ি কান প্যিন গুচ্ছগ্রামের একজন রোহিঙ্গা অধিবাসী জানান, সেনাবাহিনীর সদস্যরা শটগান ও অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে গ্রামে হামলা চালায়। যাওয়ার সময় ঘরগুলোয় আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সবকিছু আগুনে পুড়ছে। আমরা এখন ধানক্ষেতে আশ্রয় নিয়েছি। পালানোর চেষ্টা চালাচ্ছি।
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রাখাইন প্রদেশের কয়েক হাজার অমুসলিম অধিবাসীকে বিভিন্ন শহরে ও মঠে সরিয়ে নিয়েছে। গতকাল সোমবারও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ প্রায় ৫০০ লোককে দুটি নৌকায় চড়িয়ে প্রাদেশিক রাজধানী সিতওয়েতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এদিকে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে গতকাল ২২০ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে ফেরত পাঠিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে এরা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছিল। ফেরত পাঠানোর সময় রোহিঙ্গাদের সহায়তাকারী হিসেবে দুই দালালকেও আটক করেছে পুলিশ। রোববার দিবাগত রাতে জল ও স্থলসীমান্ত অতিক্রম করে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছিল।
সোমবার ভোরে এসব রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয় বলে জানিয়েছেন বিজিবির কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান ও টেকনাফ ২ ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম।
উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কায় কিসলু বলেন, রোববার মধ্যরাতে বালুখালী সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারী ৭৫ রোহিঙ্গাকে বালুখালী পানবাজার এলাকা থেকে আটক করা হয়। তাদের সহায়তার অভিযোগে দুই দালালকেও আটক করা হয়। তাদের মধ্যে একজন রোহিঙ্গা। পরে আটক অনুপ্রবেশকারীদের মানবিক সহায়তা দিয়ে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়।
বিজিবির লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান বলেন, পুলিশের হাতে আটক অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সোমবার ভোরেই সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
টেকনাফ থানার ওসি মাইনউদ্দিন খান জানান, রোববার মধ্যরাতে নাফ নদীর জলসীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারী আটজন রোহিঙ্গাকে আটক করে টহল পুলিশ। পরে তাদের মানবিক সহায়তা দিয়ে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়।
টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম রোহিঙ্গাদের ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, রোববার দিবাগত মধ্যরাত থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত পুলিশ ও বিজিবির পৃথক অভিযানে মোট ১৪৫ জন রোহিঙ্গাকে জলসীমানা অতিক্রমের সময় প্রতিহত করে স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়। ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫ শতাধিক রোহিঙ্গাকে আটকের পর মানবিক সহায়তা দিয়ে বিজিবি স্বদেশে ফেরত পাঠায় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
যৌথ অভিযানের প্রস্তাব বাংলাদেশের বাংলাদেশ সরকার সীমান্তে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যৌথ অভিযানের প্রস্তাব দিয়েছে মিয়ানমারকে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে ‘বাঙালি’ শব্দের ব্যবহারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল সোমবার ঢাকায় মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে এ প্রতিবাদ জানানো হয়।
গতকাল বিকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অনুবিভাগ) মঞ্জুরুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠক করেন মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ও চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স অং মিন। এ সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তরফ থেকে মিয়ানমারকে বলা হয়, গত সপ্তাহে মিয়ানমারে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাটি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তার সঙ্গে ‘বাঙালি’ শব্দের ব্যবহার নিন্দনীয়। এটি অগ্রহণযোগ্য। রাষ্ট্রদূতকে আরো বলা হয়েছে, যদি তারা মনে করে, সীমান্তে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি আছে, তাদের ধরতে ঢাকা সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। বাংলাদেশের মাটি কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করার কোনো সুযোগ না দেয়ার যে নীতি সরকারের রয়েছে, তা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে পররষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, রাখাইন রাজ্যে নতুন করে সন্ত্রাসী হামলার বিষয়ে বাংলাদেশ নিন্দা জানিয়েছে। সেই সঙ্গে এ পরিস্থিতির কারণে যে সহিংস অবস্থা বিরাজ করছে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। প্রথমত আমরা আবারো মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা আসার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। মিয়ানমারের কোনো নাগরিক যাতে এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ও নিরাপত্তা জোরদার করতে বলা হয়েছে দেশটিকে। সেই সঙ্গে মিয়ানমারের সন্ত্রাসীগোষ্ঠীকে বাঙালি আখ্যায়িত করেছে দেশটি। বিষয়টি নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। আর সেই সঙ্গে জানানো হয়েছে যে, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নীতি হলো জিরো টলারেন্স। মিয়ানমারের সীমান্তে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূলে যৌথ অপারেশন পরিচালনা করার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ।