দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভাঙাচোরা সড়ক নিয়ে সংসদ সদস্যদের অভিযোগ বাড়ছে। সম্প্রতি বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির বৈঠকে জনপ্রতিনিধিরা সড়ক-মহাসড়কের দুরবস্থার নানা চিত্র তুলে ধরেন। নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশা নিরসনে তারা সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারে নতুন প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানান। চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেন তারা।
সাম্প্রতিক মাসগুলোয় সংসদের বিভিন্ন কমিটির কার্যবিবরণীতে সড়ক-মহাসড়ক নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগের কথা উঠে এসেছে। সরকারি প্রতিশ্রুতি-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ৩২তম বৈঠকে উপস্থিত সদস্যরা বিভিন্ন সড়কের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। কমিটির সভাপতি ও রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলী তার জেলার জামতলা-হাবাশপুর সড়কের কাটাখালী থেকে গুদারবাজার পর্যন্ত রাস্তাটির অবস্থা খুব খারাপ বলে উল্লেখ করেন। একই বৈঠকে নওগাঁ-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. শহীদুজ্জামান বলেন, বগুড়া মোড় থেকে নওগাঁমুখী রাস্তাটি খুবই খারাপ। ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে কাজের শ্লথগতির বিষয়ে তিনি অসন্তোষ প্রকাশ
করেন। জনভোগান্তি দূর করে রাস্তাটি উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করার পরামর্শ দেন তিনি।
এর আগে মে মাসে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে চাঁদপুর-৫ আসনের সংসদ সদস্য মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম (বীর উত্তম) কুমিল্লা-চাঁদপুর রোডে তার নির্বাচনী এলাকার অনেকগুলো রাস্তা একেবারেই যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে বলে জানান। সড়কে নির্বিঘ্নে যান চলাচলের সুবিধার্থে তিনি তিনটি সড়ক পুনর্নির্মাণেরও পরামর্শ দেন।
গত জুনে অনুমিত হিসাব-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও সারা দেশের ভাঙাচোরা সড়কের বিষয়টি উঠে আসে। বৈঠকে একাধিক সংসদ সদস্য তাদের জেলার বেহাল সড়কের কথা তুলে ধরে দ্রুত মেরামতের উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেন। বৈঠকে সংসদ সদস্যরা সারা দেশের বিপন্ন রাস্তাগুলো দ্রুত সংস্কারের ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেন। একই সঙ্গে ঠিকাদারদের কাজের গুণগত মান বৃদ্ধির ওপরও জোর দেয়ার সুপারিশ করেন তারা।
সড়ক-মহাসড়ক নিয়ে বিভিন্ন কমিটির বৈঠকে আলোচনায় সংসদ সদস্যরা রক্ষণাবেক্ষণের দুর্বলতাকেই সড়কের দুরবস্থার জন্য দায়ী করেন। তারা বলেন, সড়ক তৈরি বা মেরামতের পর রক্ষণাবেক্ষণে মনোযোগ দেয়া হয় না। আবার রাস্তার ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি লোডের গাড়ি চলাচলের কারণেও তা দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। কোনো সড়ক কোথাও ভেঙে গেলে মেরামতে দ্রুত উদ্যোগ নেয়া হয় না বলেও সংসদ সদস্যরা অভিযোগ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশের মহাসড়কগুলোয় প্রতিনিয়ত অতিরিক্ত পণ্য নিয়ে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান চলাচল করছে। নির্ধারিত ওজনের বেশি মালামাল বহনে পিছিয়ে নেই পিকআপ বা মিনি ট্রাকও। এক্সেল লোড নীতিমালা না মেনে কখনো কখনো নির্ধারিত ওজনসীমার দ্বিগুণ পণ্য বহন করছে বিভিন্ন মোটরযান। এতে করে বিভিন্ন সড়ক ও সেতুতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে এবং সেগুলো দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সড়ক-মহাসড়কে অতিরিক্ত ভারবাহী বাস-ট্রাক চলাচল করায় সড়কের যে ক্ষতি হয়, তা মেরামতে বছরে ৩০০ কোটি টাকার বেশি খরচ করতে হয়।
মোটরযানে এক্সেল লোড না মানা ও অতিরিক্ত পণ্য বহনের বিষয়টি স্পস্ট হয় দেশের বিভিন্ন এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের জরিমানা আদায়ের চিত্রে। নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত ওজন বহনের জন্য জরিমানা করার বিধান রেখে ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। অতিরিক্ত ওজন বহন করায় জুলাই পর্যন্ত ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে ১৪ কোটি টাকারও বেশি জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এক্সেল লোড নীতিমালা না মেনে পণ্য পরিবহনের দায়ে জরিমানার পাশাপাশি মামলাও করা হচ্ছে। তার পরও চলছে অতিরিক্ত ওজন বহন।
জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এমএএন সিদ্দিক বণিক বার্তাকে বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাড়তি ভাড়ার আশায় ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানে অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন করা হয়ে থাকে। ফলে দ্রুত সড়ক-সেতু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানে অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন করা হলে জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। চালককে সঙ্গে সঙ্গে তা পরিশোধ করতে হচ্ছে।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের (এইচডিএম) সর্বশেষ রিপোর্টেও সারা দেশে সড়কের বেহাল চিত্র উঠে এসেছে। জানা যায়, সারা দেশে জেলা শহরের ৪৭ শতাংশ সড়কই ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিভিন্ন শ্রেণীর সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ২১ হাজার ৩০২ কিলোমিটার। এর মধ্যে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ৩ হাজার ৮১৩ ও ৪ হাজার ২৪৭ কিলোমিটার। আর জেলা সড়কের দৈর্ঘ্য ১৩ হাজার ২৪২ কিলোমিটার। অর্থাত্ দেশব্যাপী বিস্তৃত সড়ক নেটওয়ার্কের ৬২ শতাংশই জেলা সড়ক। দেশের প্রায় ১৬ হাজার ৬২১ কিলোমিটার সড়কের ওপর জরিপের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা— এ তিন পর্যায়ে সড়কগুলোর ওপর এ জরিপ চালানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে জেলা সড়কগুলোর মধ্যে ভালো বা সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে ৫২ দশমিক ৯২ শতাংশ। বাকি ৪৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ রয়েছে ভাঙাচোরা অবস্থায়।