রোহিঙ্গা নিয়ে নতুন করে চাপে পড়েছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের সীমান্ত প্রদেশ রাখাইনে রোহিঙ্গা ও সরকারি বাহিনীর সংঘর্ষের পর সেখান থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা।
অবৈধ অনুপ্রবেশকারী কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে বাংলাদেশ সরকার যখন সোচ্চার, ঠিক সে সময়েই মিয়ানমারে ফের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল। এ ছাড়া মিয়ানমারের রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশন গত বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন দেয়। তাতে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং দেশটির নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যও আহ্বান জানানো হয়। এর এক দিনের মাথায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল। মিয়ানমার সরকারের দাবি, বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গারা ২৪টি পুলিশ পোস্টে সমন্বিত হামলা চালানোর পাশাপাশি একটি সেনা ঘাঁটিতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে রোহিঙ্গা, পুলিশ এবং সেনা সদস্যরা রয়েছে। সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৯০ জনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ১২ জন বাদে প্রত্যেকেই রোহিঙ্গা মুসলিম। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশে মিয়ানমারের ৩০ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গাসহ ৪ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। রোহিঙ্গাদের কারণে মাদক পাচার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। তবে জননিরাপত্তার মতো সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কক্সবাজার থেকে অন্যত্র স্থানান্তরের কাজও চলছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এমন এক পরিস্থিতিতে ফের অনুপ্রবেশের ঘটনায় বাংলাদেশকে বেশ চাপে ফেলে দিয়েছে। জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সংঘর্ষ শুরুর পর থেকেই রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশের দিকে আসতে থাকে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কক্সবাজার সেক্টর সূত্রে জানা গেছে, টেকনাফ সীমান্তে ১৪৬ রোহিঙ্গাকে আটক করার পর মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)। গতকাল বেলা ১১টার দিকে টেকনাফের নাফ নদ পার হয়ে মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে বিজিবির সদস্যরা তাদের আটক করে। পরে তাদের একই পয়েন্ট দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক মেজর শরিফুল ইসলাম জমাদ্দার ১৪৬ জনকে ফেরত পাঠানোর তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী সন্ত্রাসী আলেকিন গ্রুপ ও পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আর রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে সীমান্ত প্রহরী বিজিবি, কোস্টগার্ড ও পুলিশ সদস্যরা।
অন্যদিকে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবুল খায়ের জানান, সীমান্তবর্তী উখিয়ার পালংখালির রহমতের বিল দিয়ে রোহিঙ্গারা যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে জন্য বিজিবির সঙ্গে তারা সেখানে অবস্থান করছেন। পালংখালি সীমান্তের ওপারে চাকমারঘাটা এলাকায় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছে। তবে সন্ধ্যা হলেই এদের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করছেন তিনি। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা একজন রোহিঙ্গা অভিযোগ করেন, গভীর রাত থেকে মংডুর নাইকাদং ও কোয়াংছিদং গ্রামে হামলা চালায় মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। তারপরই প্রাণ বাঁচাতে অনেক রোহিঙ্গা পরিবার নাফ নদের পাড়ে গিয়ে অবস্থান নেয়। কেউ কেউ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে।
গত বছরের ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ক্যাম্পে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এ হামলা চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য মারা যান। অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটের ঘটনা ঘটে। এরপর আবার একই ধরনের হামলার তথ্য দিল মিয়ানমার সরকার।
জাতিগত দ্বন্দ্বের জেরে ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে দেশটির উত্তর-পূর্ব রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতা চালাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী। জাতিগতভাবে নির্মূল করতে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের গ্রামে আগুন দিয়ে বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়াসহ গণহত্যা ও গণধর্ষণ চালায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সহিংসতার শিকার হয়ে গত বছরের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে ২০১২ সালের জুনেও মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আক্রান্ত রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। ওই সময় সরকার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে শক্ত অবস্থান নেয়। যার ফলে ওই সময় সাড়ে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা পুশব্যাক করা হয়।