চলতি মাসে শ্রম মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় ২৪ আগস্টের মধ্যে শ্রমিকদের উৎসব ভাতা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। এছাড়া বকেয়া পরিশোধসহ আগস্টের ৭০-৭৫ শতাংশ বেতন পরিশোধের বিষয়েও সভায় ঐকমত্যে এসেছিল শ্রম খাতসংশ্লিষ্ট সব পক্ষ। কিন্তু প্রতিশ্রুত সময়সীমা শেষ হলেও উৎসব ভাতা পরিশোধ করেননি শিল্প মালিকরা। এ নিয়ে গতকাল প্রায় সাতটি শিল্প-কারখানায় অস্থিরতা দেখা দেয়।
উৎসব ভাতা ও বকেয়া পরিশোধের দাবিতে গতকাল সকালে মিছিল-সমাবেশ করার উদ্যোগ নেন চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামিতে অবস্থিত পোশাক কারখানা গোল্ডেন হরাইজন লিমিটেডের শ্রমিকরা। এ কারখানায় ৩ হাজার ২৭০ জন শ্রমিক কাজ করেন। পরে শিল্প পুলিশের হস্তক্ষেপে শ্রমিকরা তাদের কর্মসূচি থেকে সরে আসেন। ২৭ আগস্ট পর্যন্ত প্রাপ্য পরিশোধের সময় আছে জানিয়ে শ্রমিকদের শান্ত করে শিল্প পুলিশ।
এদিকে গতকাল বিকালে ঢাকার মিরপুর সাড়ে ১১তে রাস্তা অবরোধ করেন কাইনাত গার্মেন্টসের শ্রমিকরা। এ কারখানার শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ৪০০। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় তাদের শান্ত করা হয়। রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত জুলাইয়ের বকেয়া, আগস্টের ১৫ দিনের মজুরি ও উৎসব ভাতা আদায় নিয়ে সমঝোতামূলক আলোচনা চলছিল।
মালিকপক্ষের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী উৎসব ভাতা ও প্রাপ্য পরিশোধ পরিস্থিতি জানতে গতকাল শিল্পসংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অধিকাংশ কারখানাই শ্রমিকের প্রাপ্য পরিশোধ সম্পন্ন করেনি। শ্রমিক প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ কারখানা উৎসব ভাতাসহ অন্যান্য প্রাপ্য পরিশোধ করেছে।
বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, শ্রমিকের উৎসব ভাতা পরিশোধ করেছে এমন কারখানার সংখ্যা ১০ শতাংশের বেশি নয়। অনেকেই শ্রমিকের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে উৎসব ভাতা দিয়ে থাকে। আবার অনেক মালিক রয়েছেন, যারা পূর্ণাঙ্গ বেতনও দিতে চান না। বরাবরের মতো এবারো মালিকরা চাহিদা অনুযায়ী উৎসব ভাতা পরিশোধে গড়িমসি করছেন।
এদিকে শিল্প পুলিশের তথ্যমতে, সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ কারখানায় প্রাপ্য পরিশোধ হয়েছে। তবে শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) এবং পোশাক শিল্প মালিক প্রতিনিধিদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যমতে, প্রায় ৭০ শতাংশ কারখানায় বেতন-বোনাস পরিশোধ হয়েছে।
জানতে চাইলে শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. নওশের আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শিল্প-কারখানাগুলো শ্রমিকের প্রাপ্য পরিশোধ শুরু করেছে। যেসব কারখানায় সমস্যার আশঙ্কা ছিল, সেগুলোয় আমরা ব্যক্তিপর্যায়ে যোগাযোগ ও আলোচনা করছি। আশা করছি, কোনো সমস্যা হবে না।’
জানা গেছে, ‘শিল্প পুলিশ-১ ঢাকা’-এর আওতায় রয়েছে আশুলিয়া, সাভার ও ধামরাই এলাকায় মোট ১ হাজার ৭৩টি কারখানা। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে ৩০ শতাংশ বা ৩৪৩টি কারখানায় বেতন ও উৎসব ভাতা পরিশোধ হয়েছে। গতকাল সমস্যা দেখা দিয়েছে, এমন কারখানার মধ্যে আছে এসিসি, লিন্ডা ফ্যাশনসহ প্রায় পাঁচটি কারখানা। এ শিল্প এলাকায় ৮৭টি কারখানায় শ্রম অসন্তোষের আশঙ্কা ছিল, যার মধ্যে ৬৭টিই পোশাক খাতের। এসব কারখানার মধ্যে ৩৩টিতে শ্রম অসন্তোষের আশঙ্কা সবচেয়ে ছিল বেশি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে কয়েকটি কারখানায় গতকালও পরিস্থিতি অস্থির হয়েছিল।
‘শিল্প পুলিশ-২ গাজীপুর’-এর আওতায় রয়েছে ১ হাজার ৮০০টিরও বেশি কারখানা। এর মধ্যে অসন্তোষের আশঙ্কা রয়েছে ১৩২টিতে। এর ১৩টি বাদে অন্য সবই পোশাক খাতের। গতকাল পর্যন্ত এ এলাকায় সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ কারখানা বেতন ও উৎসব ভাতা পরিশোধ করেছে বলে ধারণা দিয়েছে শিল্প পুলিশ।
‘শিল্প পুলিশ-৩ চট্টগ্রাম’-এর আওতায় রয়েছে মোট ১ হাজার ৮টি কারখানা। এর মধ্যে ৬৫টিতে অসন্তোষ হতে পারে বলে ধারণা করছে শিল্প পুলিশ। ৬৫টি কারখানার মধ্যে ছয়টি বাদে অন্য সব কারখানা পোশাক শিল্পের। ২৩ আগস্ট পর্যন্ত পোশাক খাতের ৬৫টি ও অন্যান্য খাতের ৪৭টি অর্থাৎ ১১ শতাংশ কারখানা উৎসব ভাতা পরিশোধ করে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ২০ শতাংশ কারখানা শ্রমিকের প্রাপ্য পরিশোধ করেছে বলে জানিয়েছে এ এলাকার শিল্প পুলিশ কর্তৃপক্ষ।
২ হাজার ৪৪২টি কারখানার আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে ‘শিল্প পুলিশ-৪ নারায়ণগঞ্জ’। এর মধ্যে ৭২টি কারখানায় শ্রম অসন্তোষের আশঙ্কা আছে, যার ৫১টিই আবার পোশাক খাতের। গতকাল সন্ধ্যায় যোগাযোগ করা হলে এ অঞ্চলের শিল্প পুলিশ কর্তৃপক্ষ জানায়, সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ কারখানা শ্রমিকের প্রাপ্য পরিশোধ করেছে।
জানা গেছে, ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনার মতো দেশের শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় সব খাত মিলিয়ে সাড়ে ছয় হাজারের কিছু বেশি শিল্প-কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে পোশাক কারখানা রয়েছে ৩ হাজার ২৭৮টি। বাকিগুলো অন্যান্য খাতের। এসব কারখানার মধ্যে বিভিন্ন সমস্যায় শ্রম অসন্তোষপ্রবণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে ৩৮৫টি কারখানাকে। এর মধ্যে পোশাক শিল্প-কারখানা রয়েছে ৩০০টি। বাকি ৮৫টি কারখানা অন্যান্য খাতের।
জানতে চাইলে পোশাক শিল্প মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, অধিকাংশ কারখানায় শ্রমিকের বকেয়া ও অগ্রিম বেতন এবং উৎসব ভাতা পরিশোধ হয়েছে। সঠিক পরিসংখ্যান আমরা আগামীকাল সংগ্রহ করে জানাতে পারব।
অন্যদিকে কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক ড. আনোয়ার উল্লাহ বলেন, আমার বিশ্বাস, ৭০ শতাংশ কারখানায় শ্রমিকের প্রাপ্য পরিশোধ হয়েছে। গতকাল আমরা সব জেলার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেছি। কোথাও বড় ধরনের কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে, এমন ঘটনা জানা যায়নি।