বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তা প্রতিনিয়তই তথ্য সংগ্রহ করে তা প্রধান কার্যালয় ও দফতরে পাঠাচ্ছেন। উজান থেকে নেমে আসা ঢলে প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকা নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে। তাই প্রকৃতপক্ষে কত টাকার ক্ষতি তা জানার জন্য বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন বিভাগের (এলজিইডি) ক্ষতির পরিমাণও আনুমানিক ৫ হাজার কোটি টাকা। কৃষি বিভাগের আনুমানিক ক্ষতি প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। মত্স্য ও পশুসম্পদ বিভাগের ক্ষতির পরিমাণও প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে রেল খাতের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা। সারা দেশে ৩৫ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সম্পূর্ণ ও ২৮৯ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; যা মেরামত করতে কমপক্ষে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। বন্যাকবলিত এলাকায় যেসব পাকা, আধাপাকা, কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ক্ষতির পরিমাণও কয়েক কোটি টাকা। এ ছাড়া সারা দেশে প্রায় ৩ হাজার স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তীরবর্তী এলাকায় অবস্থিত কয়েক শ স্কুল-কলেজ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। গ্রামীণ রাস্তার পুল, কালভার্ট, ছোট-বড় সড়ক ব্যাপকভাবে ক্ষতি হয়েছে।সড়ক-মহাসড়কের ব্যাপক ক্ষতি : সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আওতাধীন প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার সড়ক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতি কিলোমিটার রাস্তা মেরামত করে চলাচলের উপযোগী করতে কমপক্ষে ১ কোটি টাকা ব্যয় হবে। সে হিসাবে ৩৫০ কিলোমিটার সড়ক মেরামতে ৩৫০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। আর ক্ষতিগ্রস্ত এই ৩৫০ কিলোমিটার সড়ককে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ব্যয় করতে হবে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে সারা দেশে এলজিইডির অধীন গ্রামীণ সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দুই দফা বন্যাসহ টানা তিন মাসের বৃষ্টিতে সারা দেশে কমপক্ষে সাড়ে ৬ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় ক্ষতি হওয়া এসব সড়ক-মহাসড়ক মেরামতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অথচ চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ১ হাজার ৭০৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। সড়ক ও পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক। বিশেষ করে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গগামী মহাসড়কটির প্রায় ৬০ ভাগই ক্ষতির মুখে পড়েছে। এ ছাড়া ঢাকা-দৌলতদিয়া-খুলনা মহাসড়কের ৬৫ কিলোমিটারেরও বেশি খানাখন্দে ভরা। ফেনী-নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর মহাসড়কের সিংহভাগ যান চলাচলের অযোগ্য। ঢাকা-গাজীপুর, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের অনেকাংশই ভেঙে গর্তে পরিণত হয়েছে। ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের সিরাজগঞ্জ থেকে শেরপুর পর্যন্ত ভাঙাচোরা; যা দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেরামত করতে না পারলে ঈদে ঘরমুখো মানুষকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হবে। তবে মন্ত্রণালয়সূত্র বলছে, প্রতিদিনই বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তা সংস্কার করাটাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী শহিদুল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ ধরনের দুর্যোগে বন্যার পানি স্থায়ী হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। বিশেষ করে রাস্তাঘাটে পানি জমে থাকলে সেই রাস্তাঘাট নষ্ট হয়ে যায়। কার্পেটিং উঠে যায়। এমনকি কোথাও কোথাও খানাখন্দের সৃষ্টি হয়; যা মেরামত করাটাও সময়সাপেক্ষ। এ বছরও সে ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোকে চলাচলের মোটামুটি উপযোগী করতে হলেও প্রতি কিলোমিটারে কমপক্ষে ১ কোটি টাকা ব্যয় হবে মেরামতে। আর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলে আরও অনেক বেশি খরচ হবে বলে মনে করেন তিনি।
কৃষি খাতের ক্ষতি : এবারের দুই দফা বন্যায় এখন পর্যন্ত ৩৩ জেলার ফসলি জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে, এই জমির পরিমাণ ৪ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬ লাখ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গতকাল পর্যন্ত দ্বিতীয় দফা বন্যায় দেশের ২৭ জেলার ১৩৮ উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ১৩ লাখ পরিবারের বন্যাক্রান্ত হয়েছে ৫৭ লাখ ১৮ হাজার মানুষ। এ পর্যন্ত শিশুসহ ৯৩ জন মারা গেছেন। বেসরকারি হিসাবে অবশ্য মৃত্যের এই পরিসংখ্যান ১০৭। তবে বন্যায় কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা নির্দিষ্ট করে জানাতে আরও সময় লাগবে। এদিকে অবশ্য প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর বলেছে, গবাদিপশুর খুব একটা ক্ষতি হয়নি। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, বন্যাকবলিত ৩৩ জেলার মোট আবাদি জমি ২৬ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ হেক্টর জমির ফসল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রোপা আমনের জমি; যার পরিমাণ ৪ লাখ ৬২ হাজার হেক্টর। এ ছাড়া ৫ হাজার ৩২৩ হেক্টর আমন বীজতলা, শাক-সবজি ৮ হাজার ৫৭০ হেক্টর, বোনা আমন ৪ হাজার ৪৩৯ হেক্টর এবং আউশ ফসলের ক্ষতি প্রায় ৮ হাজার হেক্টর জমির। সাড়ে ৬ লাখ হেক্টর জমিন ধান হিসাবে বিবেচনা করলে যে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় তা হলো প্রতি হেক্টরে ৩ টন চাল পাওয়া যায়। সে হিসাবে প্রায় ৮০০ কোটি থেকে ১ হাজার কোটি টাকার চাল পাওয়া যেত সাড়ে ৬ লাখ হেক্টর জমি থেকে; যা আনুমানিক আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ হিসাবে ধরা যেতে পারে। তবে আশার দিক হচ্ছে বন্যার পানি দ্রুত নেমে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত জমিগুলোয় অন্য কোনো সবজি বা ধান চাষ করে অন্তত ৬০ শতাংশ ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক। তিনি গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এবারের বন্যায় কৃষি খাতের ক্ষতি লক্ষণীয়। তবে বন্যার স্থায়িত্ব কম হলে ক্ষতি অনেকটাই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। ’
গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে বানভাসি মানুষ : বন্যায় বিভিন্ন এলাকার দিঘি-পুকুর থেকে বিপুল পরিমাণ মাছ বেরিয়ে গেছে; যার পরিমাণ আনুমানিক ২ লাখ টন। এ ক্ষতি পোষাতে মাছ চাষিদের প্রণোদনা দিয়ে নতুন করে পোনা ছাড়ার সুযোগ করে দেওয়া হবে; যার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত মাছ চাষিরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন বলে আশা করছে মত্স্য অধিদফতর। তবে বন্যায় আশঙ্কার চেয়েও বেশি ক্ষতি হয়েছে গবাদিপশুর ক্ষেত্রে। কিন্তু অনেক জায়গায় আশ্রয় কেন্দ্রগুলো ডুবে যাওয়ায় লক্ষাধিক গবাদিপশু পানিতে ভেসে গেছে। এ ছাড়া বর্তমানে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, জামালপুরসহ বন্যাকবলিত উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোয় গবাদিপশুর নানা ধরনের রোগবালাই দেখা দিয়েছে। ফলে অনেক কম দামে পশু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে বন্যাকবলিত মানুষ। এতে অনেকেই বন্যার ধাক্কা কেটে উঠলেও আরেক দফা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে বানভাসি মানুষ। ধারণা করা হচ্ছে, এবারের বন্যায় মত্স্য ও পশুসম্পদ বিভাগের ক্ষতির পরিমাণও প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। তবে ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ জানতে হলে আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছে মত্স্য ও পশুসম্পদ বিভাগ। দিনাজপুর-৫ আসনের এমপি প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তার নির্বাচনী এলাকা এবারের বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই অঞ্চলের কৃষকের গবাদিপশু এবং মাছের ঘেরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিপুল পরিমাণ মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বানভাসি মানুষকে অনেক বেগ পেতে হবে।
রেলওয়ের ক্ষতি : বন্যার পানির তোড়ে অনেক স্থানে রেললাইনের নিচের মাটি সরে গিয়ে হয়েছে পুকুরের মতো বড় বড় গর্ত। ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ছিল। শুধু তাই নয়, রেললাইনের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়ায় দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঈশ্বরদী-ঢাকা রেলপথের টাঙ্গাইল জেলায় রেললাইনের মাটি সরে যাওয়ায় উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাগামী সব ট্রেন বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব ও পশ্চিম রেলস্টেশন পর্যন্ত চলাচল করেছে। যাত্রীদের সেতুর পূর্ব পাড়ে নেমে বাসে ঢাকায় যেতে হয়েছে। এতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এ ছাড়া অনেক এলাকায় রেললাইনের পাটাতন সরে গেছে। কয়েক শ কিলোমিটার রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। যেগুলো দ্রুত মেরামত করতে হবে। এতে রেললাইনের নিচে নতুন করে মাটি ভরাট, যেসব ব্রিজ ভেঙে পড়েছে সেগুলো এবং ঝুঁকিপূর্ণ অংশগুলোর মেরামতে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে বলে জানিয়েছে রেল মন্ত্রণালয়। এদিকে খুলনা থেকে ঢাকাগামী লাইনের অ্যাপ্রোচের অংশে প্রায় ২০ ফুট মাটি ধসে যায়। রেললাইনে পানি ওঠায় ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় রুটে ১২ আগস্ট থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার দুরমুঠ, দেওয়ানগঞ্জ রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন জায়গায় লাইনের ওপর দিয়ে পানির প্রবাহ অব্যাহত থাকায় জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। মাটি ও স্লিপার সরে যাওয়ায় এসব এলাকার লাইনগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. রিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘চলমান বন্যায় দেশের ৩০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বিস্তার ও স্থায়িত্বে ১৯৮৮ ও ’৯৮ সালের দুটি বড় বন্যার মতো ভয়াবহ না হলেও এবারের বন্যায় মৃতের সংখ্যা ওই দুই বছরের হিসাব ছাড়িয়ে গেছে। ’ তিনি জানান, ‘দেশে বড় বন্যার মধ্যে ১৯৯৮ সালে প্রায় ৬৮ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। আর ’৮৮ সালে বন্যাকবলিত হয়েছিল প্রায় ৬৪ শতাংশ এলাকা। সে সময় অনেক এলাকায় বন্যা দুই মাসের বেশি সময় স্থায়ী হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়।
ত্রাণ সহায়তা অব্যাহত: বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ সহায়তা অব্যাহত রেখেছে সরকার। এখন পর্যন্ত বন্যাপ্লাবিত এলাকার জন্য ২০ হাজার ৭৭০ টন চাল, নগদ ৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা ও ৩৭ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের ঘর নির্মাণের জন্য ৫০ হাজার বান্ডিল ঢেউটিন ও ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া হাওরাঞ্চলের ৬ জেলার ৩ লাখ ৮০ হাজার পরিবারকে আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের জন্য ৩৪ হাজার ২০০ টন চাল, নগদ ৫৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।