কুড়িগ্রাম-ভুরুঙ্গামারী সড়কের পাটেশ্বরী অংশের ২০ ফুট পুরোপুরি ধসে গেছে। সড়কটি ধরে ১০০ মিটার এগোলে আরো ২০ ফুটও ভাঙাচোরা। এতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ভুরুঙ্গামারীর সঙ্গে জেলা শহরের সড়ক যোগাযোগ। বিকল্প হিসেবে নৌকাই এখন ভরসা উপজেলাবাসীর।
একই অবস্থা বন্যাকবলিত জেলাগুলোয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) আওতাধীন অধিকাংশ পল্লী অবকাঠামো বিশেষ করে সড়কের। বন্যায় কোনো কোনো সড়কের পুরোটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কোনোটার অর্ধেক থাকলেও বাকি অর্ধেক নেই। ভেঙে পড়েছে বহু সেতু ও কালভার্ট। এলজিইডির প্রাথমিক হিসাবে, চলমান বন্যায় দেশের পল্লী অবকাঠামোর আর্থিক ক্ষতি এরই মধ্যে ৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
এলজিইডির আওতায় সারা দেশে পল্লী সড়ক রয়েছে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫৮৯ কিলোমিটার। বিভিন্ন সময় এসব সড়কে নির্মাণ করা হয়েছে ১২ লাখের মতো সেতু ও কালভার্ট। বন্যায় এসব সড়ক-সেতুর কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে, স্থানীয় কার্যালয়গুলোর মাধ্যমে সে তথ্য সংগ্রহ করেছে এলজিইডি। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব করেছে সংস্থাটি। তবে চূড়ান্ত হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে বলে জানান এলজিইডির কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে এলজিইডির সহকারী প্রধান প্রকৌশলী মাহবুব ইমাম মোরশেদ বণিক বার্তাকে বলেন, এবারের বন্যায় দেশের ২৩টি জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির একটা হিসাব করা হলেও তা চূড়ান্ত নয়। ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্য পেতে পানি নেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় বিদেশী সাহায্যেরও প্রয়োজন হতে পারে।
এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উত্তরাঞ্চলীয় জেলা দিনাজপুর। জেলার ১৩টি উপজেলাই বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এসব উপজেলার পল্লী অবকাঠামোও।
সরেজমিন দেখা যায়, জেলা ও উপজেলার সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী অনেক সড়কে খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে। বিরল উপজেলার তেঘরা থেকে বিরল মাদ্রাসা পর্যন্ত ও ফুলবাড়ি উপজেলার ফুলবাড়ি থেকে মাদিলা পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার সড়ক এখনো ভাঙাচোরা। সড়কের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক সেতু ও কালভার্টও।
এলজিইডি দিনাজপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খলিলুর রহমান বলেন, অতিবৃষ্টি ও বন্যায় জেলার ২০৪ কিলোমিটার সড়ক এবং ছোট-বড় ৭৮টি সেতু ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করা হয়েছে। গুরুত্ব বুঝে দ্রুততম সময়ে এসব সড়ক-সেতু মেরামত করা হবে।
গ্রামীণ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির চিত্র দেখা গেছে বন্যাকবলিত কুড়িগ্রাম ঘুরে। জেলার নাগেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ি উপজেলার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। জায়গায় জায়গায় সড়কের মাটি-কংক্রিট স্রোতের তোড়ে ভেসে গিয়ে ১৫-২০ ফুট গভীর গর্ত তৈরি হয়েছে। কুড়িগ্রামের অন্যান্য উপজেলার পল্লী সড়কগুলোও নাজুক অবস্থায় রয়েছে।
কুড়িগ্রাম এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ আবদুল আজিজ বলেন, এলজিইডির আওতাধীন জেলার নয় উপজেলায় ৭৮টি সড়ক ও ৩৫টি সেতু-কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও সেতু-কালভার্টগুলো মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে।
লালমনিরহাটের পল্লী অবকাঠামোও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবারের বন্যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লালমনিরহাট সদর ও হাতীবান্ধা উপজেলায় এলজিইডির আওতাধীন সড়কগুলো। সদর উপজেলার কুলাঘাট বাজার থেকে দক্ষিণ শিবের কুটি, মোগলহাট ইউনিয়নের পুরলদহ থেকে বুমকা (কামারপাড়া), মহেন্দ্র নগর ইউনিয়নের ঢেপঢেপির বাজার থেকে মাশানপুরা পর্যন্ত সড়কসহ জেলার ৩৫টি ইউনিয়নে এলজিইডির বিভিন্ন সড়ক এখনো চলাচলের অনুপযোগী অবস্থায় রয়েছে।
লালমনিরহাট এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী জাকিউর রহমান বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ভাঙাচোরা সড়কগুলোর সংস্কার ব্যয় নিরূপণ ও নকশা প্রণয়নের কাজ চলছে। বরাদ্দ পেলে দ্রুত মেরামতকাজ শুরু হবে।
এর বাইরে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে সিলেট বিভাগে এলজিইডির আওতাধীন পল্লী অবকাঠামোরও। সংস্থাটির হিসাবে, কেবল সিলেট জেলায় এলজিইডির আওতাধীন প্রায় ২১৭ কিলোমিটার পাকা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাঁচা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরো বেশি, প্রায় ৩৫৪ কিলোমিটার। এলজিইডির আওতাধীন সিলেট জেলার ক্ষতিগ্রস্ত পাকা সড়কগুলো মেরামতে প্রায় ৩৪ কোটি টাকা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
ক্ষতিগ্রস্ত এসব সড়ক-সেতু দ্রুত মেরামত প্রয়োজন বলে প্রাথমিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে এলজিইডি। সংস্থাটি বলছে, বন্যার পানি কমার পর সড়কগুলো দ্রুত চালু করা না গেলে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান নষ্ট হবে। পল্লী অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়বে।
এলজিইডির তথ্য অনুযায়ী, এবারের বন্যায় যেসব জেলার পল্লী অবকাঠামো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার মধ্যে আছে— পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট, বগুড়া, নওগাঁ, জামালপুর, শেরপুর, ফরিদপুর ও রাজবাড়ী। ক্ষতিগ্রস্ত এসব পল্লী অবকাঠামো মেরামতে এরই মধ্যে অগ্রাধিকারভিত্তিক একটি নীতিমালা তৈরি করেছে সংস্থাটি। একই সঙ্গে বৈদেশিক সাহায্যে চলমান প্রকল্পগুলোর সঙ্গে বন্যা পুনর্বাসন কম্পোনেন্ট সংযোজন করে অতিরিক্ত বরাদ্দ পাওয়া যায় কিনা, তা নিয়েও আলোচনা চলছে।