আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার ১৩ বছরেও শেষ হয়নি। তবে মামলার বিচারকাজ শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে।
ইতিমধ্যে এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া নিয়মানুযায়ী বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে আরও কয়েকটি ধাপের কার্যক্রম সম্পন্ন করে চলতি বছরের মধ্যেই এ মামলার রায় ঘোষণা করার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে দীর্ঘ প্রত্যাশিত এ মামলায় ১৩ বছর পর বিচারের অপেক্ষার পালা শেষ হওয়ার আশা করছেন রাষ্ট্রপক্ষ। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ মামলায় স্বাভাবিক গতিতে বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে যেসব বাধা ছিল, তার সমাধান হয়েছে। ইতিমধ্যে ২২৫ জন সাক্ষীর জেরা সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া আসামিপক্ষে ১২ জনের সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় এ সুযোগ রাখা হয়েছে। আসামি পক্ষের সাফাই সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণের পর মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শুরু হবে। তা শেষ হওয়ার পর রায়ের জন্য দিন ধার্য করা যাবে। বিচার প্রক্রিয়ার বাকি এই ধাপগুলো খুব শিগগিরই শেষ হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্যই এ ন্যক্কারজনক হামলা চালায় আসামিরা। ওই হামলার করুণ স্মৃতি নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন অনেকে। অনেকেই হাত-পা হারিয়ে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে বিচারের আশায় ১৩ বছর ধরে অপেক্ষা করছেন। একসময় নিরাশও হয়েছিলেন তারা। কারণ ঘটনার গুরুত্ব নষ্ট করতে তদন্ত ভিন্ন খাতে নিতে নানা চেষ্টা করেছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। একযুগ পরে অবশেষে মামলার বিচার এখন শেষ হওয়ার পথে। ইতিমধ্যে এ মামলার অন্যতম আসামি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু এবং হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নেতা আবু তাহের, তাজউদ্দিন, মাজেদ ভাটসহ জঙ্গি নেতাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ উঠে এসেছে। এর আগে এ মামলার পলাতক আসামিদের পক্ষে মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পলাতক সব আসামির বিরুদ্ধেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা রয়েছে। যারা বিদেশে রয়েছেন, তাদের ফিরিয়ে আনার আইনি প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। অন্যদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তত্পর। পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরাতন কারারক্ষী ব্যারাক ভবনে ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিশেষ এজলাসে এ মামলার বিচারকাজ চলছে। ২২ ও ২৩ আগস্ট আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষীর জন্য দিন ধার্য করেছেন বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন। মামলা সূত্রে জানা গেছে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশে দলীয় সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় দলীয় নেত্রী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থক, সাংবাদিক, পুলিশ ও নিরাপত্তাকর্মীসহ কয়েকশ মানুষ। এ ঘটনায় তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলেও তিনি বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হন এবং শ্রবণশক্তি হারান। পরে এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে মতিঝিল থানায় দুটি পৃথক মামলা হয়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ৯ জুন সিআইডির সিনিয়র এএসপি ফজলুল কবির ২২ জনকে আসামি করে আদালতে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুই মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন। পরে মামলা দুটি বিচারের জন্য একই বছর দ্রুত বিচার আদালতে স্থানান্তরিত হয়। এরই মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের কারণে ৬১ জনের সাক্ষী হওয়ার পর ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট দুটি মামলার অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের তত্কালীন বিচারক মো. মাসদার হোসেন। অধিকতর তদন্তের আদেশে নেপথ্য মদদদাতা ও গ্রেনেডের উত্স সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার কথা বলা হয় আদেশে। এরপর সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ মামলাটির অধিকতর তদন্ত শুরু করেন। পাশাপাশি মামলাটি ভিন্ন খাতে পরিচালনা ও জজ মিয়া নাটক সাজানোর ঘটনায় সিআইডির সাবেক তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় মামলা করা হয়। বর্ধিত তদন্তের পর সিআইডি অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আইডিপি নেতা আবদুস সালাম ও কাশ্মীরি জঙ্গি ইউসুফ ওরফে মাজেদ ভাট এবং আবদুল মালেকের দেওয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসে গ্রেনেডের উত্স। বর্ধিত তদন্তকালে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন মাওলানা আবদুস সালাম, কাশ্মীরি জঙ্গি মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক ও মামলার প্রথম অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি হরকাতুল জিহাদ নেতা (হুজি) মুফতি হান্নান। পরে দ্বিতীয় দফায় এ মামলায় ১৬৪ ধারায় ফের জবানবন্দি দেন মুফতি হান্নান। এতে এ হামলার ষড়যন্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহের বিষয়ে কয়েকজন নতুন আসামির নাম প্রকাশ করা হয়। মামলার তদন্ত নতুন দিক পায়।
আসামিরা কে কোথায় : এ মামলার মোট ৫২ আসামির মধ্যে ১৮ জন এখনো পলাতক। জামিনে রয়েছেন আটজন। কারাগারে আছেন ২৩ জন। এ ছাড়া জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এবং সিলেটে ২০০৪ সালে তত্কালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় মুফতি হান্নান ও শরিফ শাহেদুল আলম বিপুলের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় তাদের তিনজনকে এ মামলার আসামির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পলাতক আসামিদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি লন্ডনে রয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী ওয়ান-ইলেভেন আসার সঙ্গে সঙ্গেই আত্মগোপনে চলে যান। পরে ভারত হয়ে দুবাই ও সর্বশেষ লন্ডনে আছেন। হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি-বি) শীর্ষ নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন রয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল এ টি এম আমিন আহমদ আছেন যুক্তরাষ্ট্রে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার কানাডায় এবং সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতা কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ রয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। হানিফ পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হানিফ প্রথমে কলকাতায় থাকলেও এখন রয়েছেন থাইল্যান্ডে। পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান ও ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক ডিসি (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান ইউরোপে অবস্থান করছেন। রাতুল আহমেদ বাবু ওরফে রাতুল বাবু আছেন ভারতে। মাওলানা মহিবুল মুত্তাকিন ও আনিসুল মুরসালিন ওরফে মুরসালিনও রয়েছেন ভারতের তিহার কারাগারে। হুজি সদস্য মোহাম্মদ খলিল, জাহাঙ্গীর আলম বদর, ইকবাল, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা লিটন ওরফে দেলোয়ার হোসেন ওরফে জোবায়ের ও মুফতি শফিকুর রহমান কোথায় আছেন সেই তথ্য কারও কাছেই নেই। তবে গোয়েন্দাদের ধারণা, নাম-ঠিকানা পাল্টে তারা দেশেই অবস্থান করছে। জামিনে থাকা আট আসামি হলেন— খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম আরিফ, সাবেক তিন আইজিপি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অব.) রুহুল আমিন, এএসপি (অব.) আবদুর রশিদ ও এএসপি (অব.) মুন্সী আতিকুর রহমান। কারাগারে রয়েছেন ২৩ জন আসামি— বিএনপি নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, ডিজিএফআইর ঘটনার সময়ের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তত্কালীন মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম।
জজ মিয়া নাটক : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় জজ মিয়াকে দিয়ে নাটক সাজিয়েছিলেন সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান, এএসপি আবদুর রশীদ ও সাবেক সুপারভাইজিং অফিসার এসপি রুহুল আমিন। এ কারণে আওয়ামী লীগ নেতা ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার মোখলেসুর রহমান, কম্পিউটার প্রকৌশলী শৈবাল সাহা পার্থ, জজ মিয়াসহ ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এর মধ্যে মোখলেসুর রহমানকে দিয়ে আওয়ামী লীগকে জড়ানো ও শৈবাল সাহা পার্থকে দিয়ে ভারত ও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-কে জড়িত করার জন্য এ দুজনকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে জজ মিয়াকে দিয়ে ২১ আগস্টের মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য সাজানো নাটকের কাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। এর আগে জজ মিয়াকে খুনের মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি এবং শফিকুল ইসলাম ও আবুল হাসেম রানাকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে মামলা তদন্তের নামে নাটক সাজানো হয়। পরে তাদের আদালতের কাছে হাজির করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতেও বাধ্য করা হয়। এ ছাড়া জজ মিয়াকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ানোর জন্য তার পরিবারকে সারা জীবন ভরণ-পোষণের প্রতিশ্রুতির প্রলোভন দেওয়া হয়। এভাবে জজ মিয়াকে দিয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়।