আন্তর্জাতিক চাপে শ্রম আইন, ২০০৬ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি এ নিয়ে আয়োজিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে শ্রমঘণ্টা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে সরকারের টেকনিক্যাল কমিটি। এতে আগে ‘আহার ও বিশ্রামের’ বিরতিসহ কাজের সময় ৯ ঘণ্টা ও অতিরিক্ত কাজের সময় আরো ২ ঘণ্টা ধরে মোট কাজের সময় ১১ ঘণ্টা করার প্রস্তাব দিয়েছে কমিটি।
শ্রম আইন, ২০০৬-এর সর্বশেষ সংশোধন হয়েছিল ২০১৩ সালে। চলতি বছরের জুনে জেনেভায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ১০৬তম সম্মেলনে (আইএলসি) শ্রম আইন সংশোধনসহ বাংলাদেশের শ্রম অধিকারের সুরক্ষা-সংশ্লিষ্ট বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করে আইএলও বিশেষজ্ঞ কমিটি। এসব সুপারিশের আলোকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয় বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় শ্রম আইন সংশোধনে উদ্যোগী হয়েছে সরকার।
জানা গেছে, গত সপ্তাহে গাজীপুরে শ্রম আইন সংশোধন নিয়ে তিন দিনব্যাপী এক দীর্ঘ আলোচনায় বসেন শ্রমিক, মালিক ও সরকারপক্ষের প্রতিনিধিরা। সভায় সরকার মনোনীত টেকনিক্যাল কমিটি শ্রম আইন সংশোধনের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে। পরে টেকনিক্যাল কমিটির মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শক পরিষদের প্রতিনিধিরাও আলোচনা করেন। সভায় শ্রম আইন সংশোধন-সংক্রান্ত মোট ৩১টি বিষয় উত্থাপিত ও আলোচিত হয়।
এ বিষয়ে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শক পরিষদের সদস্য বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, ‘দীর্ঘ সভায় শ্রম আইন সংশোধনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ মুহূর্তে বিষয়ের সংখ্যা বলতে পারছি না। তবে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে শ্রমিক প্রতিনিধিত্ব, অসদাচরণ, ছাঁটাই কর্তৃত্ব ও ইপিজেড আইনের মতো কিছু বিষয়ে চূড়ান্ত ঐকমত্যে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। এছাড়া কর্মঘণ্টা সম্প্রসারণের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। আমরা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি। ভাষাগত পরিবর্তনের মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা হবে বলে মনে করছি।’
প্রসঙ্গত, বিদ্যমান শ্রম আইনে কর্মঘণ্টা সম্প্রসারণ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে, ‘কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকের কাজের সময় এমনভাবে ব্যবস্থা করিতে হইবে, যেন ধারা ১০১-এর অধীন তাহার আহার ও বিশ্রামের বিরতিসহ ইহা দশ ঘণ্টার অধিক সম্প্রসারিত না হয়। তবে সরকার কর্তৃক সাধারণভাবে কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে প্রদত্ত অনুমতির ভিত্তিতে এবং তত্কর্তৃক আরোপিত শর্তে ইহার ব্যতিক্রম করা যাইবে।’
জানা গেছে, ধারাটি প্রসঙ্গে সরকারের টেকনিক্যাল কমিটির প্রস্তাবনা ছিল, ‘ধারা ১০১-এর অধীন তাহার আহার ও বিশ্রামের বিরতিসহ ইহা দশ ঘণ্টার অধিক সম্প্রসারিত না হয়।…’ অংশটির ‘দশ ঘণ্টা’কে ‘এগারো ঘণ্টা’ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হোক।
এ বিষয়ে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শক পরিষদের মন্তব্য হলো, আইনের ২(৪) ধারায় বিবৃত ‘কর্মঘণ্টা’র সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘কর্মঘণ্টা হচ্ছে আহার ও বিশ্রামের সময় ব্যতীত যে সময়ে কোনো শ্রমিক কাজ করার জন্য মালিকের এখতিয়ারাধীন থাকেন।’ সুতরাং বিরতিসহ স্বাভাবিক কাজের সময় ৯ ঘণ্টা। অতিরিক্ত কাজের সময় ২ ঘণ্টাসহ মোট ১১ ঘণ্টা। অর্থাত্ এখানে ‘দশ’ শব্দটিকে ‘এগারো’ দিয়ে প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে কমিটি।
গাজীপুরে অনুষ্ঠিত শ্রম আইন সংশোধন-সংক্রান্ত সভা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক জানান, ‘আলোচনার সব বিষয়ে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছতে পারিনি। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া, তাই আরো আলোচনা হবে। আশা করছি, শিগগিরই সব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছা সম্ভব হবে।’
জানা গেছে, জুনে আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে আইএলসিতে অংশ নেয় বাংলাদেশ। সেখানে সাসটেইনেবিলিটি কম্প্যাক্ট, ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রম আইন সংশোধনসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে বেশকিছু বক্তব্য ছিল আইএলওর। এ সময় কিছু আইন সংশোধনসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করা হয়। এর মধ্যে আগস্টের মধ্যে শ্রম আইন সংশোধন ও আইএলওতে ইপিজেডের আইন সংশোধনের খসড়া জমা দেয়ার অনুরোধ উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া বাংলাদেশের শ্রম আইন ও বিধি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করাসহ বেশকিছু সুপারিশ দিয়েছে আইএলও বিশেষজ্ঞ কমিটি। কমিটি যেসব বিষয় গুরুত্বসহ বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে, তার মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) খসড়া তৈরি, পোশাক খাত-বিষয়ক ত্রিপক্ষীয় পরামর্শক কমিটির কার্যকারিতা বৃদ্ধি ও ইপিজেড আইনের খসড়া তৈরির বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া আইএলওর আগের অধিবেশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন অগ্রগতিও যথেষ্ট নয় বলে মত দেয় কমিটি। বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে চারটি বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করে কমিটি।
এ চারটি বিষয়ের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে বাংলাদেশে শ্রম আইন ও বিধিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। বিশেষ করে এ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশনের সিদ্ধান্তগুলো যেমন— ইউনিয়ন গঠনের স্বাধীনতা এবং সামাজিক অংশীদারদের চিহ্নিত অগ্রাধিকারকে আমলে নেয়ার সুপারিশ করেছে আইএলও বিশেষজ্ঞ কমিটি। ইপিজেড আইনের খসড়ার বিষয়ে বলা হয়েছে, আইনে শ্রমিক ও চাকরিদাতার ইউনিয়ন গঠনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।