দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বেড়ে মানুষ ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি অব্যাহত রয়েছে।
বন্যাকবলিত এলাকায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে বর্ণনাতীত দুর্ভোগে পড়েছেন। পানিতে তলিয়ে গেছে লাখ লাখ হেক্টর জমির আমন ধান ও শাক-সবজি। ভেসে গেছে পুকুরের কোটি কোটি টাকার মাছ। হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যায় গত তিন দিনে জামালপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, রংপুর, সুনামগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, নওগাঁ ও সিরাজগঞ্জে মোট ৩৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এদের বেশিরভাগই শিশু। কুড়িগ্রামে শুকনো জায়গার অভাবে লাশ দাফন করতে না পেরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে পানিতে। বন্যার কারণে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম বুড়িমারী স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। জামালপুরের বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ’৮৮-র বন্যার রেকর্ড ছাড়িয়েছে যমুনার পানি। গতকাল সকালে এই পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ১৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এদিকে তীব্র বন্যার কারণে ৮০০ ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে। অর্ধাহারে-অনাহারে রয়েছে পানিবন্দী লাখো মানুষ। ত্রাণ সহায়তা অপ্রতুল বলে অভিযোগ করেছেন দুর্গতরা। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—নীলফামারীতে দুই কিশোরের মৃত্যু : নীলফামারীর সৈয়দপুরে বন্যার পানি প্রবাহ কিছুটা কমলেও এখনো উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন ও পৌরশহর পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। বন্যার পানিতে দুই কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। গত চার দিনের টানা বর্ষণে চিকলী ও খড়খড়িয়া নদীর পানি বেড়ে সৈয়দপুর উপজেলায় বন্যা দেখা দেয়। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়ে উপজেলার ৩০ হাজার মানুষ। রবিবার সকালে পশ্চিম পাটোয়ারী পাড়ায় খড়খড়িয়া নদীর বাঁধ ভেঙে সৈয়দপুর শহরের পাটোয়ারী পাড়া, বসুনিয়া পাড়া, কুন্দল, নয়াবাজার ও বাঁশবাড়ী এলাকায় নদীর পানি ঢুকে পড়ে।
এদিকে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সোমবার থেকে কমতে থাকে তিস্তার পানি। গতকাল সকাল থেকে নদীর নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। নীলফামারীর সৈয়দপুরে বন্যার পানিতে ডুবে শহরের আবদুল হামিদের ছেলে আরিফ হোসেন (১৪) ও হাতিখানার জয়নাল হোসেনের ছেলে সিরাজুল ইসলাম রতন (১৭) নামে দুই কিশোরের মৃত্যু হয়েছে।
নওগাঁয় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি : নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার বেতগাড়ী, ঘোষগ্রাম ও কৃষ্ণপুর নামক স্থানে আরও ৫টি স্থানে ছোট যমুনা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জেলা সদরের সঙ্গে আত্রাই উপজেলা ও নাটোর জেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যার পানিতে নওগাঁর ৬টি উপজেলার প্রায় লক্ষাধিক বিঘার ফসলি জমি তলিয়ে গেছে এবং কয়েক হাজার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। আত্রাই নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ২০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। মান্দায় নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অন্তত ৩০টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আতঙ্কে রয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। শহরের পুরনো কালেক্টরেট ভবন চত্বর. জেলা প্রশাসকের বাসভবন, পুলিশ সুপারের বাসভবন, জেলা পরিষদের ডাকবাংলো, মুক্তির মোড়, কাজীর মোড়, বিহারী কলোনি, বনানীপাড়া, উকিলপাড়া, কালীতলা, পার-নওগাঁ ১ থেকে দেড় ফিট পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
লালমনিরহাটে আরও ২ জনের মৃত্যু : লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। গতকাল সকালে সদরের মোগলহাট এলাকায় ধরলার পানিতে ডুবে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত ব্যক্তিরা হলেন- মোগলহাটের ইটাপোতা গ্রামের জহির আলীর ছেলে আয়নাল আলী (১৩) এবং জারি ধরলা গ্রামের ওমর মিয়ার ছেলে ওয়াজেদ মিয়া (৪৬)। এ নিয়ে গত তিন দিনে বন্যার পানিতে ৯ জনের মৃত্যু হলো। জেলার ৩৫টি ইউনিয়নে প্রায় ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে অমানবিক জীবন-যাপন করছেন। এসব মানুষের মাঝে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের ৩য় বৃহত্তর বুড়িমারী স্থলবন্দরের আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম। এদিকে পানিবন্দী মানুষগুলোর মাঝে দেখা দিয়েছে ত্রাণ সংকট। অনাহারে-অর্ধহাারে রয়েছে পানিবন্দী লাখো মানুষ। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বানভাসি মানুষদের মাঝে গতকাল পর্যন্ত ৯ হাজার ৩০০ শুকনা প্যাকেট খাবার, ১৯৭ টন চাল ও নগদ ৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। তিস্তা ও ধরলার প্রবল স্রোতে গতকাল ভোরে অর্ধ-শতাধিক বসতবাড়ি বিলীন হয়েছে।
এদিকে তীব্র বন্যায় ৮০০ ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলো বললেন, আমরা জারি ধরলা চর থেকে জীবন নিয়ে বাংলাদেশে এসেছি। অনেক মানুষ সেখান থেকে ভারতে ঢুকতে পেরেছে। কিন্তু আমরা ৭-৮শ’ লোক আটকা ছিলাম। নিরূপায় হয়ে বাংলাদেশের দিকে চলে আসি। বিজিবির লোকজন যদি আমাদের ঢুকতে না দিতো তাহলে ধরলার পানিতে ডুবে আমরা নিশ্চিত মারা যেতাম। বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, ধরলার ভয়াবহ বন্যা থেকে জীবন বাঁচাতে ভারতীয় দুই গ্রামের প্রায় আট শতাধিক ভারতীয় নারী-পুরুষ ও শিশু বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলার মোগলহাট ও দুর্গাপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন।