গত সোমবার কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের বন্যাদুর্গত কয়েকটি এলাকায় গিয়েছিলাম। দেখে আসা বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে লেখাটি শুরু করার আগে অনেকক্ষণ বসে থাকলাম। লেখার ভাষার বদলে এক এক করে অনেক অসহায় মুখ মনের মধ্যে ভাসতে থাকে। কুড়িগ্রামের পাঁচগাছি ইউনিয়নের নওদাবস বাঁধে আশ্রয় নেওয়া লতিফা বেগম বলছিলেন, ‘এক বেলা খাই, দুই বেলা অইদনে (উপাস) থাকি।’ পাশে একজনকে দেখিয়ে দিয়ে তিনি আরও বলছিলেন, ‘কাইল (কাল) এঁয় (এ) সারা দিন খায় নাই।’ ধরলার পূর্ব দিকে সড়কের আশ্রয়কেন্দ্রের পাশে ছোট ছোট তিনটি শিশু। মলিন মুখ, হাড্ডিসার চেহারা। খালি গায়ে দাঁড়ানো। কী খেয়েছে প্রশ্নের উত্তরে বলছে, ‘চিড়া’। দুদিন থেকে শুধু চিড়া খেয়ে আছে তারা।
লালমনিরহাটের গোকুণ্ডা ইউনিয়নের রশিদা বেগম নিজের পা দেখাচ্ছিলেন। পানিতে ভিজে দগদগে হয়েছে। লালমনিরহাটের খেদাবাগ নতুন ঈদগাহ মাঠে কয়েক শ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। এক বৃদ্ধ কয়েক কেজি চাল শুকাতে দিয়ে পাশে বসে আছেন। চাল ভিজেছে কীভাবে জিজ্ঞাসা করতেই বৃদ্ধ নুরুল ইসলাম বললেন, ‘বাবা, খুব সকালে বাড়িত পানি উঠচে। কিছু নিবার পারি নাই। ধান ঘরেই আছে। ভেজা চাউল খাওয়ার জন্যে আনচি।’
কুড়িগ্রামের নওদাবস বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে কয়েক হাজার পরিবার। সরু বাঁধের দুদিকে ছোট ছোট প্লাস্টিকের তাঁবু। একেকটি প্লাস্টিকের তাঁবুর নিচে কয়েকটি করে পরিবার। ওই সব পরিবারের মানুষ, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি সব একসঙ্গে আছে। বৃষ্টি হলে ভেজা ছাড়া কোনো উপায় নেই। দুদিন টয়লেটের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। অনেক দূর থেকে কেউ কেউ পানি নিয়ে এসে খেয়েছেন। ধরলার উত্তরে দেখলাম পানি বিশুদ্ধকরণ মেশিন বসানো হয়েছে। সেখানে বিশুদ্ধ পানি নেওয়ার জন্য বানভাসি মানুষের দীর্ঘ লাইন। শামসুল হক নামের একজন জানালেন, সকালে মুড়ি খেয়ে বিকেল পর্যন্ত পানি খেতে পারেননি। এখন কোথাও কোথাও জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে টয়লেট ও টিউবওয়েলের ব্যবস্থা হয়েছে। একই অবস্থা বন্যাদুর্গত সব এলাকায়। মানুষ যেখানেই একটু উঁচু স্থান পেয়েছে, সেখানেই আশ্রয় নিয়েছে। এমনকি মসজিদের ভেতরেও আশ্রয় নিয়েছে নারী-পুরুষ, গৃহপালিত পশু। এসব স্থানে ঘুমানোর ব্যবস্থা নেই। তারা সারা রাত জেগে থাকে। খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
লালমনিরহাটের খেদাবাগের নতুন ঈদগাহ মাঠে পৌঁছাতেই দেখি অনেক মানুষের ভিড়। কাছে গিয়ে ভিড় ঠেলে দেখি রাজারহাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নুর মো. আক্তারুজ্জামান, ছিনাই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সাদেকুল ইসলাম শুকনো চিড়া বিতরণ করছেন। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে শুধু যে বিত্তহীন জনগণ আশ্রয় নিয়েছে, তা নয়। বিত্তবানেরাও স্থান নিয়েছে। তাদের সাহায্য প্রয়োজন না হলেও কষ্টের সীমা নেই। বন্যায় বৃদ্ধ-শিশু এবং যারা অসুস্থ, তাদের জীবন আরও ভয়াবহ হয়ে পড়েছে। কুড়িগ্রামের কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদে শফিউর নামের একজন বললেন, আশপাশের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে গর্ভবতী এবং যেসব মায়ের সন্তান কোলে আছে, তাদের হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেখলাম এই ইউনিয়নের তরুণ চেয়ারম্যান রেদওয়ানুল হক খুবই উৎকণ্ঠায়। তিনি নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী খিচুড়ি রান্না করে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন।
লালমনিরহাটের বড়বাড়ী, কুড়িগ্রামের ছিনাই ও বেলগাছা ইউনিয়নে কোনো দিন বন্যা হয়নি। ১৯৮৮ সালেও না। ছিনাইয়ে ৮২ বছর বয়সী সৈয়দ আলী বলছিলেন, ‘হামরা তো দূরের কথা, বাপ-দাদার কাছেও এখানে বন্যা হওয়ার কথা শুনি নাই।’ এই এলাকাগুলোতে প্রচুর সবজি চাষ হয়। কুমড়া, পটোল, শসা, সাতপুতি, ঢ্যাঁড়স, বেগুনসহ প্রায় সব ধরনের সবজি চাষ হয়। প্রচুর কাঁচা মরিচও হয়। লালমনিরহাটের বাংটুর ঘাটের পাশে কয়েকটি স্থানে বাঁধ ভেঙে ধরলার পানি এসব এলাকায় প্রবেশ করেছে। অনেক বাড়িঘরও বিলীন হয়েছে। অকস্মাৎ বন্যায় এসব এলাকার সব সবজিখেত পানিতে ডুবে গেছে। মাত্র তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে এসব এলাকায় চার-পাঁচ ফুট পানির নিচে ঘরবাড়ি, আবাদি ফসল ডুবে গেছে। কুড়িগ্রামের কাঁঠালবাড়ী ও বেলগাছার মিলনস্থলে মুক্তারাম নামক স্থানে ইউসুফ আলীর বাড়ি। অকস্মাৎ পানির স্রোতে পাকা করা দুটি কক্ষ, ফ্রিজ-টেলিভিশন বের করার আগে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়ক ডুবে যাওয়ার কারণে এক দিন সারা দেশের সঙ্গে কুড়িগ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। সড়কের অনেক স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কয়েক স্থানে মহাসড়ক ভেঙে কুড়িগ্রামের সঙ্গে নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ী, ভূরুঙ্গামারীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কুড়িগ্রামের টগরাইহাট নামক স্থানে রেললাইনের স্লিপার পানির স্রোতে ভেসে গেছে। ফলে রেল যোগাযোগ এখন বন্ধ।
ফসলের মাঠগুলোতে এখন অনেক পানি। দেখলে মনে হবে যেন একেকটি নদী। অথচ এই পানির নিচে ডুবে আছে কৃষকের স্বপ্ন। যাঁরা মাছ চাষ করেছেন, তাঁদের মাথায় হাত। প্রায় সব পুকুর এখন পানির নিচে। পুকুরের মাছ এখন সবখানেই। জালে প্রচুর মাছ ধরা
পড়ছে। সেই মাছ বিক্রি হচ্ছে জলের দামে। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ডুবে আছে। যেগুলো পানিতে ডুবে যায়নি, সেগুলো আশ্রয়কেন্দ্র। ফলে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার অনেক ক্ষতি হচ্ছে।
গত মাসে দেশের অনেক স্থানে একবার বন্যা হয়েছে। বন্যাবিষয়ক বিভিন্ন পূর্বাভাসেও আগাম সতর্কবার্তা ছিল। ফলে সরকারের আরও ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। যে সামান্য ত্রাণের ব্যবস্থা সরকারিভাবে দেওয়া হচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব সামান্য। বানভাসি মানুষকে নিরাপদে আনার জন্য পর্যাপ্ত কোনো যান সরকারের নেই। স্থানীয় সাংসদেরাও কোনো ভূমিকা পালন করছেন না।
বন্যাদুর্গত এলাকায় মানুষের যে আহাজারি ও মানবেতর পরিস্থিতি দেখেছি, তা ছবিতে কিংবা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। বর্তমানে বন্যাদুর্গত এলাকায় থইথই পানি আর পানি। এই পানি নেমে যাওয়ার সময় নদীতে প্রচুর ভাঙন হবে। দেখা দেবে পানিবাহিত রোগ। সেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি থাকতে হবে এখন থেকেই। দুর্যোগ রোধে সরকারি-বেসরকারি সব উদ্যোগ জরুরি।