আজ ১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। বিভীষিকার স্মৃতিমাখা ব্যথার দিন। ৪২ বছর আগের এই দিনে ঘাতকের বুলেটে প্রাণ হারান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নবীন একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর সেই রাষ্ট্রেরই স্থপতিকে এমন নির্মমভাবে হত্যার নজির পৃথিবীতে নেই। বঙ্গবন্ধু নিজেও কখনো এ ধরনের আশঙ্কা বিশ্বাস করতে চাননি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক্সিকিউটিভ ইন্টেলিজেন্স রিভিউতে নিরাপত্তা বিশ্লেষক রামতনু মৈত্র লিখেছেন, ‘১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সফরকারী মার্কিন সাংবাদিক মার্কাস ফ্রান্ডার তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের কেউ কেউ আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাজউদ্দীন আহমদ বিষয়টি শেখ মুজিবুর রহমানকে জানান এবং তাকে বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেন।’ এতে সন্দেহ নেই যে, বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনের সতর্কতা বার্তাকে গুরুত্ব দেননি। নিজ দেশের মাটিতে তাকে কেউ হত্যা করতে পারে, এ কথা তার বিশ্বাস হয়নি।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি সবসময়ই ছিল অবারিত দ্বার। ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন— জাতির ইতিহাসের বিভিন্ন ক্রান্তিকালে জনতার স্রোত বইত ওই বাড়ির দিকে। ধানমন্ডি লেকের পাড়ে, সড়কের প্রান্তসীমায় অপেক্ষমাণ মানুষ একজনকে দেখতে, তার কথা শুনতে চাইত। মোটা ফ্রেমের চশমা পরা মানুষটির মুখেই জানা যেত দেশের প্রকৃত পরিস্থিতি। কারণ তিনিই যে বাংলাদেশ, এই মাটির কণ্ঠস্বর।
১৯৭৫ সালের এই দিনেও ভোর সোয়া ৫টায় পাঁচটি ট্রাক এসে থেমেছিল সাদা ওই ভবনের সামনে। ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একদল লোক বাড়ির মূল ফটক ডিঙিয়ে মেতে ওঠে হত্যাযজ্ঞে। হট্টগোল ও গুলির শব্দ শুনে তিনি বেরিয়ে আসেন। সফেদ কোর্তা, ধূসর লুঙ্গি। হাতে চিরচেনা পাইপ। সিঁড়ির কাছে এসেই নিচে দাঁড়ানো ঘাতককে দেখতে পান। প্রশ্ন ছোড়েন, ‘কি চাস তোরা? আমাকে কোথায় নিতে চাস?’ উদ্ধত বন্দুক হাতে এগিয়ে আসা ঘাতক থমকে যায় তার প্রবল ব্যক্তিত্বের সামনে। কোনো রকম আমতা আমতা করে বলে, ‘স্যার, আপনি আসুন।’ ঘাতক মহিউদ্দিনের কথা শেষ হতেই তার পেছনে থাকা নুর চৌধুরী এগিয়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। ‘বুক তার বাংলাদেশের হূদয়’ বলা হয় যাকে নিয়ে, তারই বুকের ডানপাশ গুলিতে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। মুখ থুবড়ে সিঁড়িতে পড়ে যান তিনি। মুখ থুবড়ে পড়ে বাংলাদেশও।
সেনাবাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল ও বিপথগামী সৈনিক এদিন বাংলাদেশের স্থপতিকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। তাদের হাতে প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, ভাই শেখ নাসের, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, কর্নেল জামিলসহ অনেকে। দেশের বাইরে থাকায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেদিন প্রাণে রক্ষা পান। বেদনাবিধুর সেই দিনের স্মৃতিকে ঘিরে ১৫ আগস্ট হয়েছে বাঙালির জাতীয় শোক দিবস।
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। জাতীয় শোক দিবস সামনে রেখে এ মাসের প্রথম দিন থেকেই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। সরকারিভাবে পালিত হচ্ছে বিভিন্ন কর্মসূচি। আজ সরকারি ছুটির দিন। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আজ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনসহ বিদেশে বাংলাদেশের মিশনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। সকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ এবং সশস্ত্র বাহিনী গার্ড অব অনার প্রদান করবে। এছাড়া ফাতেহা পাঠ ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার বনানী কবরস্থানে জাতির পিতার পরিবারের শাহাদত বরণকারী সদস্য ও অন্যান্য শহীদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ফাতেহা পাঠ করবেন। গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এছাড়া সেখানে ফাতেহা পাঠ, সশস্ত্র বাহিনীর গার্ড অব অনার প্রদান এবং মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। পাশাপাশি সমাধিস্থলে বিশেষ দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, অধিদপ্তর ও সংস্থা জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্ব-স্ব কর্মসূচি পালন করবে।
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সারা দেশের মসজিদসমূহে বাদ জোহর বিশেষ মোনাজাত এবং মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সুবিধাজনক সময়ে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিও বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। জাতীয় দৈনিক ও সাময়িকীতে ক্রোড়পত্র প্রকাশ এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিশু একাডেমি এবং বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর জাতীয় শোক দিবস ও বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক বক্তৃৃতার আয়োজন করবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় শোক দিবসে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এসব কর্মসূচি পালিত হবে।