খেলাপি ঋণীর প্রাসাদ বিলাস

Slider অর্থ ও বাণিজ্য

base_1502216089-1

গাজীপুরের টঙ্গীতে নয় একর জায়গার ওপর প্রাসাদোপম অট্টালিকা ‘বুলবুল’। হেলিপ্যাড থেকে শুরু করে সুইমিংপুল, স্টিমবাথসহ রয়েছে আধুনিক সব সুবিধাই। চারতলা ভবনের আসবাবসহ অন্দরসজ্জার প্রায় সব উপকরণই এসেছে বিদেশ থেকে। বিলাসবহুল এ অট্টালিকা নির্মাণে আনন্দ শিপইয়ার্ডের কর্ণধার আবদুল্লাহেল বারী ব্যয় করেছেন ৩০০ কোটি টাকার বেশি। জনশ্রুতি আছে, এ ব্যয়ের সবটাই তিনি করেছেন আনন্দ শিপইয়ার্ডের নামে নেয়া ঋণের অর্থে। জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা এখনো প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এর বড় অংশ আবার খেলাপি।

ভবন নির্মাণে ব্যবহূত পাথরসহ অন্যান্য উপকরণ আমদানিতেও অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন আনন্দ গ্রুপের কর্ণধার আবদুল্লাহেল বারী। বাড়িটি নির্মাণে বিদেশ থেকে উপকরণ আনা হলেও তার শুল্ক পরিশোধ করা হয়নি বলে জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একটি সূত্র। সংস্থাটি বলছে, নির্মাণ উপকরণ আমদানি করলেও আনন্দ গ্রুপের কর্ণধার তা দেখিয়েছেন তার প্রতিষ্ঠানের নামে আনা কাঁচামাল হিসেবে। তবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো তদন্ত না হওয়ায় বিস্তারিত তথ্য নেই বলে জানান এনবিআরের এক কর্মকর্তা।

ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করলেও ২০০৯ সালে টঙ্গীতে প্রাসাদোপম ভবন নির্মাণ শুরু করেন আবদুল্লাহেল বারী। ২০১৪ সালে ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। গতকাল ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, তিন পাশে নদীর সঙ্গে বাড়ির মূল পাইলিং ও বাউন্ডারি ওয়াল ছাড়া কোথাও ইটের ব্যবহার নেই। আব্দুল্লাহপুর-গাজীপুর বাইপাস সড়ক থেকে বাড়িতে প্রবেশের মূল দরজা ছাড়াও পেছন রয়েছে আরো একটি প্রবেশপথ। নদী থেকে সরাসরি বাড়িতে প্রবেশের সুযোগও রাখা হয়েছে। বাড়িটি নির্মাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত স্থানীয়রা জানায়, সম্পূর্ণ পাথরে নির্মিত বাড়িটির বিভিন্ন ধরনের উপকরণ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, মিসর ও সিঙ্গাপুর থেকে।

বাড়িটিতে কর্মরত কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আবদুল্লাহেল বারী ও আফরোজা বারীসহ মালিকদের কেউই বাড়িটিতে নিয়মিত থাকেন না। তবে এর নিরাপত্তা ও দেখভালের জন্য নিয়োজিত রয়েছেন ২৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর মধ্যে দুজন ব্যবস্থাপক, নয়জন নিরাপত্তাকর্মী, আটজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও পাঁচজন রয়েছেন রান্নাবান্নার কাজে। বাড়িতে গিয়ে বেশ কয়েকজন কর্মচারীকে পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্যস্ত থাকতেও দেখা গেছে।

বাড়ি-সংলগ্ন জারিনা কম্পোজিট টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে এক বছর আগে চাকরি ছেড়ে দেয়া আবদুল হালিম নামে এক কর্মকর্তা বলেন, গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এমডি সপ্তাহে একদিন বা দুদিন ওই বাড়িতে থাকেন। কোম্পানির কাজে বিদেশী মেহমান এলে বাড়িটিতে তোলা হয়। প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তা ছাড়া কেউই বাড়ির ভেতরে যাওয়ার সুযোগ পান না। বাড়িটি নির্মাণে ৩০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে বলে দাবি করেন সাবেক এ কর্মকর্তা।

এর পাশাপাশি আবদুল্লাহেল বারী জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে সম্প্রতি নতুন করে দুটি আটতলা ভবন নির্মাণ করেছেন বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ ও বামনডাঙ্গায়ও নতুন করে জমি ক্রয় ও বাড়ি করেছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া ময়মনসিংহের ভালুকায় ২০১০-১১ সালের দিকে বিপুল পরিমাণ জমি কেনার কথা জানান আনন্দ গ্রুপের বর্তমান ও সাবেক কর্মীরা।

এসব বিষয়ে জানতে আনন্দ শিপইয়ার্ডের চেয়ারম্যান আবদুল্লাহেল বারী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফরোজা বারীর সেলফোনে কয়েক দফা চেষ্টা করেও যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয়নি। নয়াপল্টনে আনন্দ শিপইয়ার্ডের কার্যালয়ে গিয়েও তাদের পাওয়া যায়নি।

গাইবান্ধার বামনডাঙ্গায় জন্মগ্রহণকারী আবদুল্লাহেল বারী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। ১৯৮২ সালে যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে পিএইচডি অর্জন করেন। দেশে ফিরে বুয়েটে শিক্ষকতার পাশাপাশি ১৯৯৯ সালে শিপইয়ার্ড ব্যবসায় যুক্ত হন। আনন্দ শিপইয়ার্ড ছাড়াও জারিনা কম্পোজিট টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ, আনন্দ শিপিং লাইনস, আনন্দ ইন্টারন্যাশনাল, আনন্দ ইওয়ান-ডোরেডো, আনন্দ ব্যাগ মিলস ও আনন্দ বিল্ডার্স নামে আরো ছয়টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে আনন্দ গ্রুপের।

২০ বছরের বেশি সময় ধরে টঙ্গীর কামারপাড়ায় ব্যবসা করছেন গাইবান্ধার বাসিন্দা আবদুল হামিদ মণ্ডল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই আবদুল্লাহেল বারীর সঙ্গে বড় হয়েছি। পৈতৃক কিছু সম্পত্তি থাকলেও মূলত ২০০৯-১০ সালের দিকে ব্যবসা হঠাত্ বেড়ে যায় তার। এর আগে ২০০৪-০৫ সালের দিকে জিনাত টেক্সটাইলসহ (বর্তমানে জারিনা টেক্সটাইল) টঙ্গীতে দুটি কারখানা কিনে এ অঞ্চলে ব্যবসা শুরু করেন আবদুল্লাহেল বারী। পরবর্তীতে ২০০৯ সালের পর বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণসহ কামারপাড়ায় বিপুল পরিমাণ জমি ক্রয় ও বড় দুটি গোডাউন স্থাপন করেছেন আনন্দ গ্রুপের কর্ণধার।

জানা গেছে, জাহাজ নির্মাণ ও রফতানির নামে ২০০৮ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ঋণ নিলেও এর বড় অংশ অন্য খাতে ব্যয় করেছেন তিনি। নিয়মিত তা পরিশোধ না করায় বড় অংকের ঋণ এরই মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে। জাহাজ নির্মাণ ব্যবসা গুটিয়ে আসায় ওই অর্থ আদায়ে উদ্বেগ বাড়ছে ব্যাংকগুলোর।

প্রায় ৮০০ কোটি টাকা আদায়ে ২০১৫ সালে আনন্দ শিপইয়ার্ডের বিরুদ্ধে মামলা করে প্রতিষ্ঠানটিতে সবচেয়ে বেশি অর্থায়নকারী ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। সর্বশেষ হিসাব বছরে তারা কিছু ঋণ পরিশোধ করেছে। তার পরও আনন্দ শিপইয়ার্ডের কাছে ৫৭৭ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বলে ব্যাংকটির সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খান বণিক বার্তাকে বলেন, আনন্দ শিপইয়ার্ডের বিধ্বস্ততার কথা জানিয়ে কোম্পানির কর্মকর্তারা ব্যাংকের কাছে আকুতি জানিয়েছেন। সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ইসলামী ব্যাংক সোলেনামায় (আপস-মীমাংসা) গেছে। আশা করছি, প্রতিষ্ঠানটি ঋণ পরিশোধ করতে সমর্থ হবে।

আনন্দ শিপইয়ার্ডে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ রয়েছে জনতা ব্যাংকের। এ ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ ২৩৮ কোটি টাকা। তৃতীয় সর্বোচ্চ ঋণ রয়েছে ওয়ান ব্যাংকের। সর্বশেষ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির মতিঝিল শাখার পাওনা দাঁড়িয়েছে ২২৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ বাবদ পাওনা টাকায় শীর্ষে রয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাাংকও। আনন্দ গ্রুপ সমঝোতার ভিত্তিতে ব্যাংকটিকে কিছু অর্থ পরিশোধ করলেও সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদনে মোট ঋণের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ২২৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ঋণ পুনরুদ্ধার বিভাগের প্রধান মতি উল হাসান বলেন, নৌ-মন্ত্রণালয়কে দুটি জাহাজ সরবরাহে ২০১০ সালে মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে ২৩৪ কোটি টাকার ঋণ নেয় আনন্দ শিপইয়ার্ড। তবে এনবিআরের সঙ্গে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে জাহাজ সরবরাহ করতে পারেনি। ফলে ব্যাংকের ঋণও পরিশোধ করতে পারেনি তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *