এ বছর উচ্চমাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষাগুলোতে যাঁরা উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাঁরা এখন উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ভালো বলে পরিচিত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করবেন। এবার তাঁদের ‘ভর্তিযুদ্ধ’ আগের বছরগুলোর মতো তীব্র হবে না। কারণ, এবারের মোট উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮ লাখ ১ হাজার ৭১১, আর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্নাতক পর্যায়ে মোট আসনসংখ্যা প্রায় ৮ লাখ ৫০ হাজার। অর্থাৎ, ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীর চেয়ে ভর্তিযোগ্য আসনের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার বেশি। এই অর্ধলাখ আসন এবার খালি থেকে যাবে।
আসলে এটা ঠিক হিসাব নয়, খালি থেকে যাবে আরও বেশি সংখ্যক আসন। কারণ, এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সবাই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পা রাখতে পারবেন না। আর্থিক অসামর্থ্য, বিয়ে (মেয়ে শিক্ষার্থীদের) ও অন্যান্য কারণে অনেকের শিক্ষাজীবন এ পর্যায়েই থেমে যাবে। এই ‘ঝরে পড়া’ শিক্ষার্থীর সংখ্যা যদি ৫০ হাজার হয়, তাহলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক পর্বে প্রায় এক লাখ আসন খালি থেকে যাবে।
এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে মূলত এ কারণে যে এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাগুলোর ফল আগের বছরগুলোর তুলনায় বেশ খারাপ হয়েছে। পাসের হার কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ, ফলে গত বছরের চেয়ে এ বছরের উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। কিন্তু উল্টো দিকে, এই এক বছরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে বিভিন্ন বিষয়ে আসনসংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, ভর্তিযোগ্য আসন যত আছে, ততজন শিক্ষার্থী নেই।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য আসন ফাঁকা থাকা কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা বরং উল্টোটাই: সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমাদের ছেলেমেয়েরা অনার্স-মাস্টার্স পড়ার সুযোগ পাবে না, এটা বড়ই দুঃখের বিষয় হতো।
তবে এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে দুঃখজনক একটা ব্যাপার সত্যিই ঘটেছে। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছেন এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা গত বছরের তুলনায় ২০ হাজার কম। এর মানে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শুধু যে আসন ফাঁকা থাকবে তা-ই নয়, তারা ভালো ফলের অধিকারী শিক্ষার্থীও এবার কম পাবে। এতে করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আসন পূর্ণ করার প্রয়োজনে এমন মানের শিক্ষার্থীদেরও ভর্তি করিয়ে নিতে পারে, যাঁদের বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স পড়ার উপযোগী মেধা বা প্রস্তুতি নেই।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তিযোগ্য আসনসংখ্যা শিক্ষার্থীর তুলনায় অনেক বেশি হওয়ার অন্য একটা দিক আছে এবং তা বেশ গুরুতর একটা সমস্যাকে স্পষ্ট করে তোলে। সেটা হলো এই যে আমাদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে জাতীয়ভাবে কোনো পরিকল্পনা নেই। দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স-মাস্টার্স পড়ানো হয়। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রতিবছর প্রায় ৯ হাজার শিক্ষার্থী অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আছে ২ হাজার ১০০ কলেজ, সেগুলোর মধ্যে ৭০০টিতে অনার্স-মাস্টার্স পড়ানো হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনেক কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও বেশি হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের বসার জায়গা নেই, প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নেই, তবু ভর্তিযোগ্য আসনসংখ্যা বাড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এভাবে কোনো কোনো বিষয়ের একটি বর্ষের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫০ থেকে ৩০০ পর্যন্ত হয়েছে।
এর মধ্যে সরকার পরিকল্পনা করেছে, দেশের প্রতিটি উপজেলায় ন্যূনতম একটি কলেজ থাকবে, যেখানে অনার্স-মাস্টার্স পড়ানো হবে। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে প্রায় ৯০টি।
প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের কত অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রিধারী মানুষ প্রয়োজন? কী চিন্তা থেকে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হচ্ছে, স্নাতক কলেজগুলোতে অনার্স-মাস্টার্স পড়ানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে? প্রতিটি উপজেলায় অনার্স কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা হচ্ছে? আমাদের জনপ্রশাসন, শিল্পকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সেবা খাতসহ অর্থনীতির কোন ক্ষেত্র অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রিধারী লোকবলের অভাবে চলতে পারছে না?
সরকার কি অবগত আছে, অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রিধারী কত তরুণ-তরুণী চাকরির জন্য মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর হন্যে হয়ে ঘুরেও চাকরি পাচ্ছেন না? প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের চাকরি পেতে মাস্টার্স ডিগ্রির প্রয়োজন হয় না, কিন্তু মাস্টার্স ডিগ্রিধারী অনেক তরুণ-তরুণী সেই চাকরি পেলেও বর্তে যেতেন, তবু তাঁদের অনেকেই তা-ও পাচ্ছেন না।
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারদের মধ্যে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রিধারীদের বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের শ্রমশক্তি বিষয়ে যে জরিপ করা হয়েছে তাতে দেখা যায়, মাধ্যমিক পরীক্ষায় (এসএসসি) উত্তীর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৭ শতাংশ, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় (এইচএসসি) উত্তীর্ণদের মধ্যে এই হার ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ; কিন্তু স্নাতক-পরবর্তী পর্যায়ের ডিগ্রিধারী ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ, বাংলাদেশে যে ব্যক্তির শিক্ষার ডিগ্রি যত বড়, তাঁর বেকার থাকার আশঙ্কা তত বেশি। কর্মসংস্থানের তীব্র সংকটের এই দেশে একটা ভালো খবর হলো স্নাতক পর্যায়ের নিচ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন এমন ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার কয়েক বছর ধরে ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। ২০১৩ সালের জরিপেই উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিন বছরে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করা তরুণ-তরুণীদের বেকারত্বের হার কমেছে, কিন্তু একই সময়ে স্নাতক (সম্মানসহ) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের বেকারত্ব সাড়ে ৬ শতাংশ বেড়েছে।
২০১৩ থেকে পরবর্তী চার বছরে জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, কিন্তু কর্মসংস্থান তেমন বাড়েনি। সে কারণে কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ আমাদের প্রবৃদ্ধিকে ‘কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি’ বলে বর্ণনা করছেন। এই কর্মসংস্থানহীনতার সবচেয়ে বড় শিকার যখন সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীরা, তখন উচ্চশিক্ষা বিস্তারের চলমান তৎপরতার পেছনে কোনো বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু সরকার কারিগরি শিক্ষা প্রসারের কথাও জোর দিয়ে বলছে। কাজও কিছু হয়েছে, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির হার দেশের মোট শিক্ষার্থীর ১৪ শতাংশের ওপরে উঠেছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ২০২০ সালের মধ্যে এই হার ২০ শতাংশে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে
৩০ শতাংশে উন্নীত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং একটা সময় কারিগরি শিক্ষাকেই শিক্ষার মূলধারায় রূপান্তরিত করা হবে।
কিন্তু একই সমান্তরালে যদি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত কলেজগুলোতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী ভর্তি অব্যাহত থাকে এবং ক্রমেই আরও বেশি বেশি অনার্স-মাস্টার্স পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে কারিগরি শিক্ষাকে মূলধারায় পরিণত করা কীভাবে সম্ভব? যেকোনো শিক্ষার্থীই সামর্থ্য থাকলে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে চাইবে। সামর্থ্যবান অভিভাবকেরাও চান তাঁদের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষিত হোক। কিন্তু কী ধরনের উচ্চশিক্ষা নিলে কর্মসংস্থান হবে, আর কিসে বেকারত্বের আশঙ্কা আছে এই বিবেচনা শিক্ষার্থী, তার পরিবার ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে থাকা উচিত। নইলে ‘উচ্চশিক্ষার’ বোঝা জাতির জন্য দুর্বহ হয়ে উঠবে। গরিব মা-বাবার কষ্টার্জিত অর্থ খরচ করে সাত-আট বছর ধরে পড়াশোনা করে মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে বেকার ঘুরে বেড়ানো এককথায় জীবনের অপচয়।
উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনাহীন বিস্তার ও উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের বেকারত্ব নিয়ে টেলিফোনে আলাপ করেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বললেন, ম্যান পাওয়ার প্ল্যানিং বা শ্রমশক্তি পরিকল্পনা বলে একটা বিষয় আছে, যার সঙ্গে শিক্ষা পরিকল্পনার সম্পর্ক নিবিড়। আমাদের দেশে কোনো সরকারের আমলেই এ বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করা হয়নি। কিন্তু তা করা দরকার। শ্রমবাজারের কোন খাতে কোন স্তরের কত সংখ্যক জনবল প্রয়োজন, তা নিরূপণ করা দরকার। সে জন্য এ বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটা সমীক্ষা প্রয়োজন। সেই সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা দরকার কী ধরনের ও কোন স্তরের কত সংখ্যক শিক্ষিত জনবল তৈরির ব্যবস্থা করা হবে।
নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ও অনার্স কলেজ প্রতিষ্ঠা, বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে অনার্স-মাস্টার্সে ভর্তির আসনসংখ্যা বাড়ানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে বর্তমানে যে পরিকল্পনাহীনতা ও অদূরদর্শিতা লক্ষ করা যাচ্ছে, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম সেটাকে নেতিবাচক বলে মনে করেন। তিনি মনে করেন, এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা থাকা উচিত এবং সেই নির্দেশনার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন নতুন বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে শ্রমবাজারের বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমন অনেক বিভাগ ও বিষয় প্রবর্তন করা হয়েছে, শ্রমবাজারে যেগুলোর চাহিদা খুব কম।
অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সাবেক গবেষক রিজওয়ানুল ইসলাম প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বেকারত্ব কমাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোর চিত্র সে রকম নয়। বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে চিত্রটা অনেকটাই বিপরীত; এ দেশে শিক্ষিতদের বেকার হওয়ার আশঙ্কা অশিক্ষিতদের তুলনায় বেশি। কৃষকের সন্তান অনার্স-মাস্টার্স পাস করে কৃষিকাজে হাত লাগাতে লজ্জা পায়, কিন্তু সে “সম্মানজনক” কোনো চাকরিও পায় না।’
এমনিতে উচ্চশিক্ষা ভালো জিনিস, যদি তা সনদসর্বস্ব না হয়। প্রকৃত অর্থে দেশের সব মানুষ উচ্চশিক্ষিত হলে সমাজের চেহারাই পাল্টে যেত। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে যখন জীবিকার সম্পর্কটাই প্রধান বিবেচ্য, তখন উচ্চশিক্ষার ডিগ্রিধারী লোকের সংখ্যা বছরে বছরে কয়েক লাখ করে বাড়তে থাকলে ‘উচ্চশিক্ষিত’ যুবসমাজের বেকারত্ব চরম হতাশাজনক পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে।