বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ২০০৬ সালের দিকে প্রথম নেশাদ্রব্য ইয়াবার বিস্তার শুরু হয়। এখন সর্বত্রই পাওয়া যাচ্ছে এই রঙিন ট্যাবলেট। এতে আসক্ত হয়ে পড়ছে ধনীর দুলাল থেকে ফুটপাথের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত। ক্রমশ এদের সংখ্যা বাড়ছে। সিলেটে এ নেশায় যারা আসক্ত তাদের মধ্যে শতকরা ৫৫ ভাগেরই বয়স ২২ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশে ইয়াবা আসক্তি নিয়ে অনলাইন সিএনএনে এক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছেন সাংবাদিক নাথান এ থম্পসন। তার রিপোর্টের শিরোনাম ‘ইয়াবা অ্যাডিকশন: দ্য ডার্ক সাইড অব বাংলাদেশজ ইনক্রিজিং অ্যাফ্লুয়েন্স’। সংক্ষেপে এর বাংলা হতে পারে- ইয়াবা আসক্তি: বাংলাদেশে অন্ধকার অধ্যায়। এই প্রতিবেদনে ইয়াবায় আসক্ত ধনীর সন্তান রাফি, বহুল আলোচিত ঐশী রহমান, কাশেমের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে। দেখানো হয়েছে ইয়াবা কিভাবে যুব সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। নাথান এ থম্পসন লিখেছেন, ২০০৬ সালে প্রথমে ঢাকায় ইয়াবার বিস্তার শুরু হয়। এরই মধ্যে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে তা। ইয়াবা হলো মেটামফেটামিন ও ক্যাফেইনের সমম্বয়ে তৈরি এক ধরনের উজ্বল রঙের ট্যাবলেট। এটাকে এলামিনিয়ামের ফয়েলের ওপর তাপ দিয়ে তার ধোঁয়া সেবন করেন আসক্তরা। আবার কেউ কেউ এটা গুঁড়ো করে তার ঘ্রাণ শোকেন। এ খাতে অধিক থেকে অধিক হারে পাচারকারীকে আটক করছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডস (বিজিবি)। গত বছর তারা ২ কোটি ৯০ লাখেরও বেশি ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করেছে। ২০১০ সালে যে পরিমাণ ইয়াবা জব্দ করা হয়েছিল তার ৩৫ গুণেরও বেশি এই সংখ্যা। এ তথ্য মাদক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক বিভাগের দেয়া। মাদক ও অপরাধ বিষয়ক জাতিসংঘের অফিস থেকে প্রকাশিত ২০১৫ সালের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, মেকং অঞ্চল ও পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অংশে যে ইয়াবা ট্যাবলেট আটক হয় তার মূল উৎস হলো মিয়ানমার। ২০১৩ সালে চীনে যে পরিমাণ ইয়াবা আটক হয়েছে তার শতকরা ৯০ ভাগই মিয়ানমারের। বাংলাদেশের কক্সবাজারে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা দেয়ার একটি সেন্টার খুলেছেন দিদারুল আলম রাশেদ। তার ওই সেন্টারে এখন দু’ডজন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। ইয়াবার বিস্তার যে হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। রাশেদ বলেন, আমরা ২০০২ সালে একটি অনানুষ্ঠানিক জরিপ চালাই। তাতে দেখা যায় কক্সবাজার জেলার ২০ হাজার মানুষ মাদকাসক্ত। তবে তারা তখনও ইয়াবা সেবন করেন না। ওইসব মানুষ হেরোইন সহ অন্যান্য মাদক ব্যবহার করতেন। কিন্তু ২০০৭ সালে যে ইয়াবার বন্যা নেমে আসে। এর পর সর্বত্রই তা পাওয়া যায়। ২০১৬ সালে আমরা আবার জরিপ চালাই। তাতে দেখতে পাই ৮০ হাজার মানুষ মাদকাসক্ত। এর মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই ইয়াবা ব্যবহার করেন। ইয়াবা আমাদের যুব সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এখানে ঐশী রহমানের কথাই ধরা যাক। ২০১৩ সালে ১৭ বছর বয়সে ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ে সে। তাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন তার পিতামাতা। তারা তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেন। ঢাকায় তাদের বাসায় তাকে আটকে রাখেন। কিন্তু এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ঐশী। সে কফির সঙ্গে নেশাদ্রব্য মিশিয়ে তা পিতামাতাকে পরিবেশন করে। একপর্যায়ে পিতামাতার ঘুম ঘুম ভাব এলে ঐশী রান্নাঘর থেকে ছুরি এনে তাদের কুপিয়ে হত্যা করে। এ সময় সে তার ছোটভাইকে বাথরুমে আটকে রাখে। এক বন্ধুকে ফোন করে ছোটভাইকে নিয়ে যেতে বলে। এরপরেই ঐশী পুলিশের কাছে নিজে ধরা দেয়। অপরাধের কথা স্বীকার করে। ২০১৫ সালের নভেম্বরে তাকে এ অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। আদালত তার রায়ে বলেছিলেন, ঐশী সুচিন্তিত মাথায় হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। ওই ঘটনার সময় তার বয়স ছিল ১৯ বছর। এ বছর জুন মাসে ঢাকা হাই কোর্ট তার বয়স ও মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে শাস্তি লাঘব করে। তাকে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। যুব সমাজ কোথায় যাচ্ছে তার এই একটি ঘটনা দিয়ে অনুভব করা যায়। এতে বাংলাদেশে ইয়াবা আসক্তি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের ২০১৪ সালের বার্ষিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, যারা মাদক ব্যবহার করে তাদের শতকরা ৮৮ ভাগের বয়স ৪০ বছরের নিচে। উল্লেখ্য, ইয়াবা মূলত শরীরে বাড়তি শক্তি সঞ্চার করে। রক্তে উষ্ণতা বাড়ায়। ইয়াবা সেবন কারে রাফি নামের ২৪ বছরের যুবক। তিনি বলেছেন, এই ট্যাবলেট সেবন করলে উষ্ণতা অনুভব করেন। তিনি ঢাকায় ডিজে হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। এরই এক পর্যায়ে মাদক ব্যবহার শুরু করেন। এতে তিনি সারারাত জেগে থাকতে পারতেন। তার নেশা যতই বাড়তে থাকে ততই তিনি সামাজিকতাকে থোড়াই কেয়ার করতে থাকেন। বন্ধুদের মাঝে শুধু নিজেকে বড় করে দেখাতে চেষ্টা করতে থাকেন। এমনও দিন গেছে যখন তিনি একই দিনে এই তীব্র শক্তিশালী ট্যাবলেট চারটিও সেবন করেছেন। তার ভাষায়, জোর করে দু’এক ঘণ্টা ঘুমাতাম আমি। তারপর সকাল ৯টা বা ১০টার দিকে ঘুম থেকে উঠতাম। সেবন করতাম ইয়াবা। এরপর বেরিয়ে পড়তাম কাজে। কিন্তু তাতে অনেক দেরি হয়ে যেত। কাজ শেষে বন্ধুকে ফোন দিয়ে তার বাসায় চলে যেতাম সন্ধ্যা ৬টার দিকে। একজন ডিলার দিয়ে যান ইয়াবা। আমরা তখন এর নেশায় মেতে উঠতাম। একসঙ্গে প্লে-স্টেশনে ফিফা গেমস খেলতাম ২০ থেকে ৩০ বার। এই ধারা চলতে থাকে দুই বা তিন বছর। প্রতিদিনই ছিল একই রুটিন। ইয়াবা আসক্ত আরেক যুবকের নাম কাশেম। তিনি শুধু নামের শেষ অংশ দিয়ে নিজের পরিচয় প্রকাশ করেছেন। নোঙর নামে একটি সেন্টারে তিনি এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিছুটা ধাতস্থ হয়েছেন তিনি। বয়স তার ৩৭ বছর। এখন বুঝতে পারছেন যখন যুবক ছিলেন তখনকার সময়ের সঙ্গে এখন জীবন কতটা পাল্টেছে। কাশেম বলেন, ১৯৯০-এর দশকের দিকে নেশা বলতে ছিল শুধু হেরোইন ও অন্যান্য সামগ্রী। আমার পরিচিতদের মধ্যে শতকরা মাত্র ৫ থেকে ১০ ভাগ নেশা করতেন। কিন্তু এখন পুরো যুব সমাজের অর্ধেকই ইয়াবায় আসক্ত। তিনি বলে যেতে থাকেন, যখন নতুন এই নেশা দ্রব্য এল তখন সবাই চাইতো এটা সেবন করতে। হেরোইনের চেয়ে ইয়াবা ভালো। হেরোইন মানুষকে দুর্বল করে দেয়। কিন্তু ইয়াবা রক্তকে উদ্বেলিত করে। শরীরকে চাঙ্গা করে তোলে সিংহের মতো। কিন্তু এর পরবর্তী প্রভাব খুব ভয়ঙ্কর। কাশেম এখন নিজের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তার বড় ছেলে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেছে। তাকে তিনি পাঠিয়ে দিচ্ছেন সৌদি আরবে। সেখানে মাদক পাওয়া কঠিন। কাশেম বলেন, আমি তাকে সেখানে পাঠিয়ে দিচ্ছি। কারণ, আমি চাই না আমার মতো তারাও শেষ হয়ে যাক। ১৯৯০ এর দশকে মিয়ানমারের মাদক চক্র হেরোইনের পরিবর্তে ইয়াবা তৈরির দিকে মনোনিবেশ করে। এই ট্যাবলেট তৈরি আফিমের ওপর নির্ভর করে না। এটা আকারে ছোট, আকর্ষণীয় ও পাচার করা সহজ। প্রস্তুতকারকরা মাঝেমধ্যে এসব ট্যাবলেটের গায়ে বিভিন্ন ব্রান্ডের নাম দিয়ে দেয়। যেমন বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্রান্ডের নাম হলো ‘আর ৭’। স্থানীয় একটি পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, একটি আর ৭ ইয়াবা ট্যাবলেটের দাম ৯০০ টাকা। এর চেয়ে একটু সস্তা ব্রান্ডের নাম পিঙ্ক চম্পা। এর একটি ট্যাবলেটের দাম প্রায় ৩০০ টাকা। তবে সবচেয়ে কড়া ব্রান্ডের নাম ‘কন্ট্রোলার’। এর একটি ট্যাবলেটের দাম ২০০০ টাকা পর্যন্ত। চীন ও থাইল্যান্ড যখন মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করে তখন মিয়ানমারের মাদক পাচারকারী চক্র ইয়াবা পাচারের জন্য আন্তর্জাতিক মার্কেট খুঁজতে থাকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে তাদের জন্য সহজ একটি স্থান। কারণ, বাংলাদেশে রয়েছে ব্যস্ত সমুদ্রবন্দর, ফাঁকফোকর যুক্ত সীমান্ত। এ ছাড়া এখানে এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে লোভনীয় বাজার। প্রথমে ইয়াবা সেবন করতে থাকেন দৃশ্যত বাংলাদেশের অভিজাত শ্রেণি। তারাই বাকি জনসমষ্টিকে এ নেশা সেবনে উদ্বুদ্ধ করে। মাদক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের রিপোর্ট বলছে, স্মার্টনেস, ফ্যাশন ও আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে ইয়াবা। ইয়াবা সেবনকারীদের মধ্যে রয়েছেন মডেল কন্যা, সিনেমার নায়িকা, গায়িকা, নৃত্যশিল্পী এমনকি আরো অনেক সেলিব্রেটি। মাদক ও অপরাধ বিষয়ক জাতিসংঘের অফিস-এর আঞ্চলিক প্রতিনিধি জেরেমি ডগলাস বলেছেন, এ সমস্যার আসল কারণ এখনও অজানা। বাংলাদেশের একটি বৈশিষ্ট্য আছে, যার জন্য এখানে সুসংগঠিত অপরাধের বাজারে ইয়াবার আকর্ষণ রয়েছে। এখানে যে পরিমাণ ইয়াবা আটক হচ্ছে তা দিয়ে এর পরিমাণ নির্ণয় করা কঠিন। উল্লেখ্য, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে প্রায় ৪০০০ কিলোমিটার সীমান্ত। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে রয়েছে ২৫০ কিলোমিটার সীমান্ত। এসব সীমান্তে প্রহরা কড়াকড়ি করা কঠিন হয়ে পড়েছে দুর্নীতির কারণে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কক্সবাজার শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সারওয়ার কাবেরি বলেন, ইয়াবা বন্ধে আমাদের সরকার সিরিয়াস। কিন্তু তা কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ, এর পাচারের সঙ্গে জড়িত কিছু জুনিয়র কর্মকর্তা। এ ছাড়া সীমান্তের কিছু প্রহরী নগদ অর্থের বিনিময়ে এর পাচার হতে দিচ্ছে। কে যে জড়িত সেটা খুঁজে বের করা খুবই কঠিন। কক্সবাজারে মাদক নিয়ন্ত্রণ অফিসের সহকারী পরিচালক সুমন মণ্ডল। সীমান্ত রক্ষীরা দুর্নীতিতে জড়িত এমন অভিযোগে আপত্তি জানান তিনি। তিনি বলেন, মাদক বিতরণে আমার কোনো স্টাফ জড়িত এমন অভিযোগ কখনো আমি পাই নি। যদি মাদক দেশে প্রবেশ করেও থাকে তাহলে তা হতে পারে তার কর্মকর্তা, কর্মচারীর বড় ধরনের ঘাটতি। ইয়াবা বন্ধে শূন্য সহনশীলতার প্রতি সমর্থন নাজনীন সারওয়ার কাবেরির। তিনি বলেন, ইয়াবা পাচারকারীদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করবো আমি। সরকারের উচিত পুনর্বাসন কেন্দ্র বাড়ানো। বর্তমানে সরকার পরিচালিত ৫টি চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে। এ ছাড়া ৬৮টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা দেয়া হয়। এগুলোই মাদক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের তালিকায় রয়েছে।
কিন্তু পুনর্বাসনই এক্ষেত্রে একমাত্র সমাধান নয়। রাফি শুধু তার পরিবারের সমর্থনের কারণে ইয়াবা ছাড়তে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বলেন, আমার বাবা ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। তিনি আমাকে জোর করে পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠান নি। তিনি আমার সঙ্গে আলোচনা করলেন কেন আমি ইয়াবা সেবন করছি। তারপর আমি ইয়াবা ছেড়ে দিই। আমার প্রতি আস্থা রাখতে শুরু করে সবাই। হয়তো সে জন্যই তিনি এখন সফল একজন ব্যবসায়ী হতে পেরেছেন।