শ্রেণীকক্ষে পরিকল্পিত পাঠদানের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য রয়েছে শিক্ষক সংস্করণ, সহায়িকা ও নির্দেশিকা। এর প্রধান লক্ষ্য শিক্ষকদের পাঠদান কার্যক্রম সহজীকরণ ও শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত শিখনফল অর্জন। পাঠদানের ক্ষেত্রে এ নির্দেশিকা অনুসরণে শিক্ষকদের বিশেষ নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। যদিও তা অনুসরণ করছেন মাত্র ৩৬ শতাংশ শিক্ষক। প্রাথমিক শিক্ষকদের ৬৪ শতাংশই পাঠদানের ক্ষেত্রে এ নির্দেশিকা আমলে নিচ্ছেন না। এর ফলে প্রকৃত শিখন থেকে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।
বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা যাচাইসহ প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের বিভিন্ন দিক নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর একটি জরিপ চালায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন বিভাগ। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সারা দেশের ১ হাজার ১৮৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩ হাজার ২৭৮ জন শিক্ষক এতে অংশ নেন। জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে সম্প্রতি প্রকাশ করা হয় ‘ন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাসেসমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদনেই শিক্ষকদের বড় অংশের শিক্ষা নির্দেশিকা অনুসরণ না করার তথ্য উঠে এসেছে।
জরিপে পাঠদান পদ্ধতি, ক্লাসের সময়সীমা, নিজ পেশা সম্পর্কে ধারণা, বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা, বাড়ির কাজ প্রদান ও আদায় এবং পাঠ্যক্রমসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়। পাঠদান পদ্ধতির বিষয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে দেখা যায়, মাত্র ৩৬ শতাংশ শিক্ষক পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষক সংস্করণ, সহায়িকা ও নির্দেশিকাকে গুরুত্ব দেন। অর্থাৎ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদানরত অধিকাংশ শিক্ষকই শিক্ষাদান পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিতে অবহেলা করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যালয়গুলোয় বর্তমানে শিক্ষকরা যেভাবে পড়ান, তা শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো বুঝতে পারে না। কারণ শিক্ষকরা পাঠদান করেন নম্বরের উদ্দেশ্যে, শেখানোর উদ্দেশ্যে নয়। পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষাক্রম ও শিক্ষক সহায়িকা অনুসরণের কথা বলা হলেও অধিকাংশ শিক্ষকই তা দেখেন না। ফলে ত্রুটিপূর্ণ শিখন পদ্ধতিতে প্রকৃত শিখনফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, শিক্ষক সহায়িকায় শিখনফল, শিখন শেখানো কৌশল বা কার্যাবলি, শিক্ষা উপকরণ ও শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। অথচ অত্যন্ত জরুরি হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে শিক্ষকরা এ নির্দেশিকা ঠিকমতো পড়েন না। এর ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্য যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। পাশাপাশি ফলপ্রসূ হচ্ছে না শিক্ষকের পাঠদানও।
এদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রণয়নকৃত শিক্ষক সংস্করণ, সহায়িকা ও নির্দেশিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে সহজলভ্য করতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে সেগুলো আপলোড করা হয়েছে। পাশাপাশি গত ৫ জুলাই শিক্ষক সহায়িকার বিষয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের অবহিতকরণের বিষয়ে জেলা ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশও দেয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে ডিপিই মহাপরিচালক ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, শিক্ষক সংস্করণ, সহায়িকা ও নির্দেশিকা সহজলভ্য করতে সেগুলো আমাদের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আর প্রযুক্তি এখন সবার কাছে পৌঁছে গেছে। তাই শিক্ষকদের উচিত ব্যক্তিগত উদ্যোগে তা সংগ্রহ ও অনুসরণ করা।
জরিপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষকদের কাছে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। এর জবাবে ৫৯ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষকই শিক্ষকতা পেশা চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা বলেন। নিজেকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দেখতে চান ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষক। আর শিক্ষা প্রশাসনে কাজ করতে চান ৮ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষক। উপরোক্ত তিনটি লক্ষ্যের কোনোটিরই পক্ষে মত দেননি ৪ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষক। এর বাইরে ১ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষক এ পেশা ছেড়ে অন্য কিছু করার পরিকল্পনার কথা জানান। এর বাইরে দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষক শিগগিরই এ পেশা ছাড়তে চান।
এছাড়া জরিপে অংশ নেয়া ৮০ শতাংশের বেশি শিক্ষক মনে করেন, শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে তাদের অবদান রয়েছে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ নিয়েও অধিকাংশ শিক্ষক সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। শিশুদের পাঠদানের বিষয়টি উপভোগ করেন বলে জানিয়েছেন অর্ধেকের বেশি শিক্ষক।
শিক্ষকদের ওপর পরিচালিত জরিপে বিভিন্ন সমস্যার কথাও উঠে আসে। শিক্ষা অফিসের পক্ষ থেকে যোগাযোগের ঘাটতি রয়েছে বলে দাবি করেন ৭ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষক। বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে যোগাযোগের ঘাটতির কথা বলেন ৯ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষক। সহকর্মীদের কাছে সহায়তা না পাওয়ার কথা জানান জরিপে অংশ নেয়া ৭ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষক।