কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ মোটেই সস্তা নয়

Slider জাতীয়

base_1501874697-d5

কয়লা খাতের তদবিরকারীরা জ্বালানি পণ্যটিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর তাগিদে নানা ঝুটমুট যুক্তি উপস্থাপন করে চলেছেন। এর মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি কথা হলো, ‘আমাদের কয়লা প্রয়োজন। কারণ এটি সস্তা।’

অস্ট্রেলিয়ার প্রধান বিজ্ঞানীরা দেশটিতে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। এর বিপরীতে বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে রীতিমতো জবাবের পর জবাবের ঢেউ তুলে দিয়েছেন কয়লার অত্যুত্সাহী সমর্থকরা।

কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর উপায় হিসেবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দিনে দিনে বেশ ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। বিদ্যুৎ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এনার্জি অস্ট্রেলিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাথেরিন ট্যানাও সম্প্রতি এ কথা বলেছেন। বলছেন আরো অনেকেই।

ব্লুমবার্গ নিউ এনার্জি ফিন্যান্সের বিশেষজ্ঞ কোবাদ ভাভাংরিও সম্প্রতি জ্বালানি পণ্যটির রেপুটেশনাল, রেগুলেটরি ও রিটার্ন রিস্ককেই (কুখ্যাতি, বিধিগত ও মুনাফাগত ঝুঁকি) নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ব্যয়বহুল হয়ে ওঠার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ নিয়ে তার মন্তব্য হলো, ‘শুধু কল্পনার জগতেই কয়লা সস্তা’।

মিনারেলস কাউন্সিল অব অস্ট্রেলিয়া সম্প্রতি বিদ্যুতের উৎস কয়লাকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির তুলনায় বেশ সস্তা হিসেবে প্রমাণ করার এক প্রচেষ্টা নেয়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের পর এ প্রয়াস আর ধোপে টেকেনি। মিনারেলস কাউন্সিলের দাবি ছিল, আল্ট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল কোল পাওয়ার প্রযুক্তির মাধ্যমে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ১ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা অর্জনে ব্যয় হবে ১৮০ কোটি মার্কিন ডলার। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতের আন্তর্জাতিক ব্যয়রেখায় অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান নেমে আসবে নিচের দিকে (অর্থাৎ অন্যান্য দেশের তুলনায় অস্ট্রেলিয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় হবে তুলনামূলক কম)। যদিও অভ্যন্তরীণভাবে এ ধরনের প্রযুক্তি নির্মাণের সক্ষমতা অস্ট্রেলিয়ার নিজেরও নেই।

অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ান ফিন্যান্সিয়াল রিভিউ বলছে, মিনারেলস কাউন্সিলের দাবিতে তুলে ধরা সংখ্যাগুলোর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই। অস্ট্রেলিয়ার নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয় সম্পর্কে ভালো ধারণা পেতে হলে উদাহরণ হিসেবে সমজাতীয় ব্যয় কাঠামোর কোনো দেশ, যেমন— দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে দৃষ্টিপাত করলেই হবে।

দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থা এসকোম বর্তমানে দুটি কয়লাভিত্তিক আল্ট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণ করছে। মেদুপি ও কুসাইল নামে বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি বিশাল, প্রতিটির সক্ষমতা ৪ দশমিক ৮ গিগাওয়াট। ব্যয় ও টাইম ওভাররান (প্রকল্পে বাস্তবায়নে অনুমিত ও প্রকৃতরূপে অতিবাহিত সময়ের মধ্যকার ব্যবধান) বিবেচনায়ও প্রকল্প দুটি প্রায় সমান অবস্থানেই রয়েছে।

এর মধ্যে মেদুপি প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ ২০২০ সালের মধ্যে শেষ হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে মোট ব্যয় হবে ১৯ হাজার ৫০০ কোটি দক্ষিণ আফ্রিকান র্যান্ড। অন্যদিকে কুসাইল প্রকল্পটি ২০২২ সালের আগে শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ প্রকল্পে মোট অনুমিত ব্যয়ের পরিমাণ ২২ হাজার ৫০০ কোটি দক্ষিণ আফ্রিকান র্যান্ড। ব্যয়ের পরিমাণকে ডলারে রূপান্তরের পর দেখা যায়, প্রকল্প দুটিতে মোট ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলার। অন্যদিকে প্রতি হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অর্জনে দক্ষিণ আফ্রিকার গড় ব্যয় হচ্ছে ৩৩০ কোটি ডলার, যা অস্ট্রেলিয়ার মিনারেলস কাউন্সিলের দাবির তুলনায় প্রায় ৮৩ শতাংশ বেশি।

চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোও এখন অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে কয়লার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এর বিপরীতে দেশগুলো এখন নিজেদের কয়লাকেন্দ্রিক সক্ষমতাকে বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঘাড়ে গছিয়ে দিতে চাইছে।

গভীরভাবে দেখতে গেলে, এ ধরনের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন-সংক্রান্ত চুক্তিগুলোয় এখন খরচও অনেক কমিয়ে দেখানো হচ্ছে। বেমালুম চেপে যাওয়া হচ্ছে নানা ধরনের ভর্তুকিসহ বিভিন্ন পরোক্ষ খরচের কথা। ফলে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রকৃত ব্যয়ের চিত্রটা শেষ পর্যন্ত গোপনই থেকে যাচ্ছে।

জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) সম্প্রতি বাংলাদেশকে ৫০ হাজার কোটি ইয়েনের (৪৫০ কোটি ডলার) একটি ঋণ দিয়েছে, যা সংস্থাটির ইতিহাসে এখন পর্যন্ত দেয়া সর্বোচ্চ পরিমাণ ভর্তুকি ঋণ। বাংলাদেশের দক্ষিণে মাতারবাড়ীতে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বন্দর নির্মাণের জন্য এ ঋণ দেয়া হচ্ছে। মোট ১ দশমিক ২ গিগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের বৃহত্তম বিদ্যুৎকেন্দ্র।

৫০ হাজার কোটি ইয়েনের মধ্যে ৩০ হাজার কোটি ব্যয় হবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে। এর ফলে এখানে প্রতি হাজার মেগাওয়াটে ব্যয় দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২৩০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ। বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে উৎপাদনের জন্য কয়লা আমদানি ও সংলগ্ন বন্দর ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। এ বাবদ ব্যয়কে আমলে আনলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রতি হাজার মেগাওয়াট বাবদ ব্যয় দাঁড়ায় ৩৭৫-৪৫০ কোটি ডলার।

ভর্তুকি ছাড়াই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় দাঁড়াচ্ছে অনেক বেশি। এর পরেও বলতে হয়, জাইকার মতো সংস্থাগুলোর রেয়াতি ঋণের সুযোগ নিয়েই এ ধরনের প্রকল্প অনেক অল্পেই বাস্তবায়ন করতে পারছে বাংলাদেশ। খোলাবাজার থেকে ঋণ নিয়ে এ ধরনের প্রকল্প হাতে নিতে হলে মোট ব্যয় দাঁড়াত আরো অনেক বেশি।

উপরন্তু প্রকল্পের কারিগরি ও পরিকল্পনাগত সহায়তাও জাইকাই দিচ্ছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি মহাপরিকল্পনাও জাইকারই প্রণয়ন করা। সুতরাং এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে উপেক্ষা করে ব্যয়বহুল আমদানিতে কয়লা ও এলএনজি-নির্ভর প্রযুক্তির (এটিও সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে জাপানের) ওপর জোর দেয়া হচ্ছে।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় অনেক বেশি হওয়ায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এখন এতে বিনিয়োগের আগ্রহ অনেক কম। এছাড়া কার্বন ঝুঁকির কারণে এর মূলধনি ব্যয়ের পরিমাণও অনেক বেশি। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জীবদ্দশায় এর পেছনে যত বিনিয়োগ করা হয়, তার অধিকাংশই ব্যয় হয় এগুলোর দীর্ঘকাল চালু রাখার পেছনে। তার ওপর এতে যদি কার্বন ট্যাক্স যোগ করা হয়, তাহলে এ ব্যয় বেড়ে যায় আরো অনেকখানি।

ভারতের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এরই মধ্যে দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে। সরকারের বায়ুদূষণ হ্রাসের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের যে উন্নয়ন করতে হবে, তার ব্যয়ের ঠেলায় পড়ে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন সাহায্য চাইছে খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকেই। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রযুক্তিগত উন্নয়নে মোট ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ প্রয়োজন বলে প্রাথমিকভাবে হিসাব করা হয়েছে। আবার দেশটির জ্বালানি প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের সেবামূল্য বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে দেন-দরবার চালিয়ে যাচ্ছে।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের মূল্য সস্তা হওয়ার বিষয়টি যে নিছক কল্পনা, তা এসব কিছুতেই প্রমাণ হয়। বিশেষ করে চলতি বছর সোলার পিভি প্যানেল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের সেবামূল্য কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুতের তুলনায় নিচে নেমে আসার বিষয়টিতে এ প্রমাণ আরো জোরালো হয়ে ওঠে।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নতুন স্থাপনের ক্ষেত্রেই হোক, বা পুরনোগুলোর জীবনকাল বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়ার ক্ষেত্রেই হোক; কোনো অবস্থাতেই কয়লায় উৎপাদিত বিদ্যুতের ব্যয় কম বলে যুক্তি দেয়ার সুযোগ নেই। এর পরও যারা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের ব্যয় নবায়নযোগ্য জ্বালানির চেয়ে কম বলে প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করছেন, তাদের এ প্রয়াসকে হাস্যকর ও মরিয়া প্রচেষ্টা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *