রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে ফের শুরু হয়েছে পুরনো খেলা। মাঠে নেমে পড়েছেন তিনি। তৈরি করছেন কমেডি। তিনি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। কোথায় তার গন্তব্য? বাংলাদেশের রাজনীতির উপরের মহলে কখনো কখনো এ প্রশ্ন উঠেছে। তবে অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষকরা জানেন, তার গন্তব্য নিশ্চিত এবং তার জীবদ্দশায় এখন পর্যন্ত তিনি পথ পরিবর্তন করেননি। কখনো কখনো হয়তো হিসাবে ভুল করেছেন।
বৃহস্পতিবার আবার কমেডি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন তিনি। দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে তার অনেক হতাশা। অনেক সমালোচনাও করেছেন প্রধানমন্ত্রীর এই বিশেষ দূত। কিন্তু নিজের পদ তিনি ছাড়তে রাজি নন। রাজি নন নিজ দলের মন্ত্রীদেরও মন্ত্রিসভা থেকে সরাতে। বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দিলে আমরা পদত্যাগ করবো। সরকারেরও পদত্যাগ চান না তিনি। মনে করেন, এতে তৈরি হবে সাংবিধানিক শূন্যতা। রাজনীতির ইতিহাসে এমন সৌজন্যতা আর কবে কে দেখাতে পেরেছে!
সংবাদ সম্মেলনে এরশাদের পাশেই উপস্থিত ছিলেন তার ভাই এবং দলের কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের। আগের রাতে যিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট বি. চৌধুরীর বাসায় এক বিশেষ রাজনৈতিক সভায় যোগ দিয়েছিলেন। ওই বৈঠকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, জেএসডি সেক্রেটারি আব্দুল মালেক রতন, বিকল্প ধারার মাহী বি. চৌধুরীসহ দলগুলোর শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এতে বিশেষ আমন্ত্রণে যোগ দেন জিএম কাদের। এ বৈঠক এবং বৈঠকে জিএম কাদেরের উপস্থিতি দেশের রাজনীতিতে বিশেষ কৌতূহল তৈরি করে। নতুন এই জোটের আওয়াজকে স্বাগত জানিয়েছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি। শত ফুল ফুটতে দিতে বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। অনেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের আওয়াজ পাচ্ছেন। এই মেরুকরণে এরশাদের ভূমিকা কী হবে? কারো কারো মনে সংশয়। তবে একটি সূত্র এটা নিশ্চিত করেছে যে, এরশাদ তার দিক পরিবর্তন করবেন না। নির্দেশনা যেমন থাকবে তার ভূমিকাও থাকবে তেমন। কথিত বিকল্প জোটের সভায় জিএম কাদের যোগ দিলেও সেখানে তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন, এরশাদ যেমন সিদ্ধান্ত দেন তেমনটাই হবে। এর বাইরে জাতীয় পার্টি কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না।
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদে থেকে প্রধান বিরোধী দলের প্রধান হয়ে রাজনীতি করা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রাজনীতিতে চাঞ্চল্য তৈরি করা অবশ্য নতুন কিছু নয়। প্রায়শ’ই তিনি বলে থাকেন, তার হাতে রক্তের দাগ নেই। তার এই কথা শুনে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ আত্মারা কষ্ট পেলেও রাজনীতিবিদদের হয়তো তেমন কিছু আসে যায় না। স্বৈরাচারের তকমা লাগা সত্ত্বেও ক্ষমতার রাজনীতিতে অনেকদিন ধরেই এরশাদ নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে রেখেছেন। অতীতে দুটি দলই তাকে কাছে টানার চেষ্টা করেছে। তবে রাজনীতিতে তার গুরুত্ব এখন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেকটাই কম। দলের মন্ত্রী-এমপিদের ওপরও তার তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ চোখে পড়ে না। তবে রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির গুরুত্ব হারিয়ে ফেলার প্রধান কারণ অবশ্য অন্য। দলটির জনপ্রিয়তা কমতে কমতে শূন্যের কোটায় নেমেছে। নিজেদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এলাকাতেও জাতীয় পার্টি এখন আর নির্বাচনে জয়ী হতে পারছে না।
ক্ষমতাসীন দলের এক শীর্ষ নেতা প্রায়শ’ই বলে থাকেন নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে অনেক মেরুকরণ হবে। এবং এটা রাজনীতির জন্য ভালো। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এরইমধ্যে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের কিছু আলামত দেখতে পাচ্ছেন। তবে কোন প্রতিষ্ঠান থেকে এসব কার্যক্রমের প্রযোজনা হচ্ছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। গত ১৩ই জুলাই আ স ম রবের বাসায় বিকল্প জোট গঠন নিয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের বৈঠক হয়েছিল। ওই বৈঠকে পুলিশ বাধা দেয়। কিন্তু বুধবার রাতে বি. চৌধুরীর বাসায় বৈঠকে কোনো ধরনের বাধা ছিলো না। বরং ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নতুন নতুন জোট তৈরি হবে। এসব জোট কৌশলগত, আদর্শগত নয়। তারা তো ওখানে বসে ষড়যন্ত্র করছেন না।
তবে রাজনীতিতে এ জোটের গন্তব্য নিয়েও এরইমধ্যে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। ভোটের রাজনীতিতে এ জোট কতটা গুরুত্বপূর্ণ হবে, সে প্রশ্ন থাকলেও জোটের অনেক নেতারই গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। বড় বড় নাম সম্ভাব্য এ জোটকে ভারিও করেছে অনেকটা। যদিও অতীতে এ ধরনের জোট গড়ার প্রচেষ্টা বারবারই হোঁচট খেয়েছে। তার পরও এ জোটের গন্তব্যের দিকে দৃষ্টি রাখছেন পর্যবেক্ষকরা। কোনো বিশেষ পরিকল্পনায় এ জোট গড়া হচ্ছে কি না এ প্রশ্নও উচ্চারিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে জোট রাজনীতির ইতিহাস নতুন কিছু নয়। নতুন কিছু নয় জোটে ভাঙনও। দেড় দশক ধরে রাজনীতির লড়াইয়ে ছিলো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট বনাম বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। জোট রাজনীতির সুযোগেই অনেক ছোট দলের বড় নেতারা মন্ত্রিসভায়ও নিজেদের নাম লিখিয়েছেন। গত কয়েকদিনে রাজনীতিতে বেশ কিছু নতুন জোটের আবির্ভাবের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। কিন্তু এসব জোট ভোটের রাজনীতিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে- সে প্রশ্ন রয়েই গেছে।