হাসিনা সরকারকে ‘পরিণতি ভোগের’ হুমকি দেন হিলারি

Slider জাতীয়

221422Hasina2_kalerkantho_pic

 

নিষ্ঠুর কৌশল ব্যবহার করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন প্রত্যাহারের হুমকিসহ শেখ হাসিনার সরকারকে চাপের মুখে রাখতে হিলারি তার পররাষ্ট্র দফতর, ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস ও বিশ্বব্যাংক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের নিযুক্ত করেছিলেন।

এসব কর্মকর্তার পাশাপাশি হিলারি নিজেও হাসিনা সরকারকে বারবার ‘পরিণতি ভোগের’ হুমকি দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে ঋণ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি কলারের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারের পাঠানো ডকুমেন্টের বরাত দিয়ে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ডকুমেন্টগুলো বলছে, হিলারি ক্লিনটন খুব সূক্ষ্মভাবে বাংলাদেশ সরকারকে শাসাতে চেয়েছিলেন। তিনি ক্লিনটন পরিবারের দীর্ঘদিনের বন্ধু ও তাদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের দাতা মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত বন্ধ করতে বাংলাদেশ সরকারকে বাধ্য করতে চেয়েছিলেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিতে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সরকারি চ্যানেল ব্যবহার সংক্রান্ত তদন্তে ডকুমেন্ট পাঠিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগসংক্রান্ত সিনেট কমিটির অনুরোধে সম্প্রতি এ সংক্রান্ত দুটি ডকুমেন্ট পাঠায় বাংলাদেশ। অভিযোগটি তদন্ত করছে ওই সিনেট কমিটি। দ্য ডেইলি কলার নিউজ ফাউন্ডেশনের তদন্ত দলটি এসব ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে বুধবার প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

কলারের প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন ধনী বন্ধু ও ফাউন্ডেশনের দাতার (ইউনূস) সাহায্যের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার একটি দরিদ্র দেশের বিরুদ্ধে হিলারি যে নিষ্ঠুর কৌশল ব্যবহার করেছিলেন, এই ডকুমেন্ট সে দিকে নতুন করে আলো ফেলেছে। ডকুমেন্টগুলো বলছে, হিলারি ক্লিনটন ড. ইউনূসকে উদ্ধার করতে তার পররাষ্ট্র দফতর, ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস ও বিশ্বব্যাংকের শক্তিমান কর্মকর্তাদের ধাপে ধাপে নিযুক্ত করেছিলেন। অথচ ইউনূস তখন গ্রামীণ ব্যাংক নামের রাষ্ট্র মালিকানাধীন একটি ব্যাংকের অব্যবস্থাপনার জন্য তদন্তের মুখোমুখি হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাকে ব্যাংকটি থেকে অপসারণও করা হয়।

মূলত পারিবারিক সম্পর্কের সূত্র ধরে ইউনূসকে রক্ষা করতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হিলারি ক্লিনটন সরকারি চ্যানেল ব্যবহার করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ সংক্রান্ত সিনেট কমিটি তাদের তদন্তে এ দিকটিতেই জোর দিচ্ছে। ডেইলি কলারের প্রতিবেদনেও ক্লিনটন পরিবারের পারিবারিক বন্ধু ও তাদের ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের দাতা হিসেবেই ড. ইউনূসের পরিচয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউনূসের নিট সম্পত্তির মূল্য হবে এক কোটি মার্কিন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে তার অলাভজনক প্রতিষ্ঠান (গ্রামীণ আমেরিকা) থেকে তিনি ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে তিন লাখ মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছেন। এ তথ্য ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটেই রয়েছে। বাংলাদেশে ড. ইউনূস ২০১০ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের কারণে তদন্তের মুখোমুখি হন। এর মধ্য একটি ড্যানিশ ডকুমেন্টারি জানায়, ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক ফান্ড থেকে ১০ কোটি মার্কিন ডলার সরিয়ে নেন তার নিজ নামে থাকা দুটি প্রতিষ্ঠানে। এক হাজার ডলার মাথাপিছু আয়ের একটি দেশে এত বড় অর্থ স্থানান্তরের অভিযোগটি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, হিলারি ক্লিনটন বারবার ইউনূসের হয়ে হুমকি দিতেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সতর্ক করে দেন যে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাংকের অনুমোদন করা ১০০ কোটি ২০ লাখ ডলারের ঋণ প্রত্যাহার করে নিতে পারে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের সবচেয়ে বড় দাতা। ২০১১ সালে ব্যাংকটিতে যুক্তরাষ্ট্র দেড়শ কোটি মার্কিন ডলার প্রদান করে। ফলে ব্যাংকটিতে হিলারির ছিল মারাত্মক প্রভাব। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সেতুটি নিয়ে হিলারি ক্লিনটনের অ্যাকশন ছিল মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দুর্বল ও হেয় করা, যিনি মুসলিম বিশ্বের একমাত্র নারী রাষ্ট্রপ্রধান। ওই সময় ওয়াল স্ট্রিট জার্নালও এক প্রতিবেদনে বলেছিল, সেতু প্রকল্প হাসিনার সম্মানজনক প্রকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ তার ইচ্ছা, এই সেতু নির্মাণের মাধ্যমে দেশের অনুন্নত একটি অঞ্চলকে রাজধানীর সঙ্গে সংযুক্ত করবেন এবং ওই অঞ্চলে ব্যবসায়িক বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন। হিলারি ক্লিনটনের এই মুষ্টিবদ্ধ কৌশল নিয়েই এখন তদন্ত চলছে। ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের দাতার হয়ে তিনি কীভাবে ব্যাংককে ব্যবহার করেছিলেন তা এখন খতিয়ে দেখছে বিচার বিভাগ সংক্রান্ত সিনেট কমিটি।

গত ১ জুন ওই সিনেট কমিটির চেয়ারম্যান চাক গ্রাসলি এ বিষয়ে তদন্তে সহযোগিতা চেয়ে একটি চিঠি লেখেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনকে। এতে হিলারির এসব তৎপরতা এবং হাসিনা সরকারকে চাপ দিতে তার যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ছেলের আইআরএস কর অডিট করার হুমকির বিষয়েও তথ্য চাওয়া হয়। এ বিষয়ে চাক গ্রাসলি ডেইলি কলারকে জানান, তিনি এসব তথ্য পাওয়ার জন্য পররাষ্ট্র দফতরকে নিয়মিত চাপ দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, হিলারি ক্লিনটন ২০১১ সালের শুরুতে ইউনূসের বিষয়ে কথা বলার জন্য ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টিকে বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির কাছে পাঠান। দীপু মনি ছিলেন দেশটির প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশ থেকে পাঠানো ডকুমেন্টে দীপু মনির বক্তব্যও পাওয়া গেছে। তাতে তিনি বলেন, ‘মরিয়ার্টি খুব স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে, আমরা যদি সেটা (ইউনূসের বিরুদ্ধে তদন্ত) বন্ধ না করি, তাহলে আমাদের কিছু পরিণতি ভোগ করতে হবে। এর মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন প্রত্যাহারের বিষয়টিও ছিল। ’ তখন দীপু মনি মরিয়ার্টিকে বলেছিলেন, ‘একটি নির্বাচিত সরকার হিসেবে আমরা কীভাবে এমনটা করতে পারি?’ তখন মরিয়ার্টি বারবার হিলারি ক্লিনটনের এই দাবি পুনরুক্তি করছিলেন যে গ্রামীণ ব্যাংক একটি স্বাধীন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও), যা দরিদ্রদের, প্রধানত নারীদের সাহায্যের জন্য করা হয়েছে। জবাবে দীপু মনিও বোঝানোর চেষ্টা করেন যে গ্রামীণ ব্যাংক সরকারের একটি তালিকাভুক্ত ও সরকারি অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক এবং এটি এনজিও নয়। এরপর হিলারি ক্লিনটন তাদের আক্রমণের কৌশল আরও বৃদ্ধি করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে কয়েকজন মার্কিন কর্মকর্তাকে পাঠান। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও ব্লেক ছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি এবং বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেমস উলফেনসন। তারা সেখানে গিয়ে ইউনূসের বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ করতে বারবার চাপ দিতে থাকেন। একই সঙ্গে অবিলম্বে গ্রামীণ ব্যাংকের তৎকালীন নতুন চেয়ারম্যান মোজ্জাম্মেল হককে প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিতে থাকেন। ওই সময় জেমস উলফেনসনকে খুবই বিব্রত দেখায়। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ডেইলি কলার উলফেনসনের দফতরে যোগাযোগ করে। পরে তার গণমাধ্যম প্রতিনিধি জানান, এ ব্যাপারে তারা কোনো মন্তব্য করবেন না। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শুধু তাই নয়, হিলারি ইউনূসের পক্ষে আরও কিছু পদক্ষেপ নেন। তার কথামতো, সরকারকে চাপ দিতে রবার্ট ব্লেক বাংলাদেশের অভিজাত গোষ্ঠীকে দিয়ে লবিং করানোর চেষ্টা করেন। বাংলাদেশ সরকারের পাঠানো ডকুমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, ওই সফরে মরিয়ার্টির বাসভবনে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লেক ঘোষণা দিয়েছিলেন, ইউনূসকে অবশ্যই গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান পদে রাখতে হবে। অন্যথায় ওয়াশিংটনের অ্যাকশন শুরু হবে, যার বাজে প্রভাব পড়বে দুই দেশের সম্পর্কের ওপর।

ওই সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ব্লেকের পক্ষ থেকে অব্যাহত চাপ মোকাবিলা করেন। তখন একটি ফোনালাপের বিষয়ে দীপু মনি বলেন, ‘তিনি (ব্লেক) খুবই অনমনীয় ছিলেন। তিনি খুব, খুব পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন, আমাদের পরিণতি ভোগ করতে হবে, যদি আমরা (তাদের কথা শুনতে) বাধ্য না হই। ’ এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ব্লেক ডেইলি কলারকে কোনো জবাব দেননি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *