পেশাদার টেনিস সার্কিটে দীর্ঘ ১৬ বছর কাটিয়ে দিলেও ডেভিস কাপের শিরোপাটা হাতে ধরে দেখা হয়নি। শেষ পর্যন্ত সেই স্বাদও পূরণ হলো সুইস তারকা রজার ফেদেরারের। সবগুলো গ্র্যান্ড স্ল্যামের পাশাপাশি ব্যক্তিগত অর্জনের বাইরে এখন তিনি সুইজারল্যান্ডের হয়ে ডেভিস কাপের গর্বিত মালিক।চারটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম মিলিয়ে সর্বমোট রেকর্ড ১৭টি, ছয়টি এটিপি ট্যুর ফাইনালের শিরোপা, ২৩টি মাস্টার্স শিরোপা, অলিম্পিক স্বর্ণ পদক যার দখলে তার ঝুলিতে শুধুমাত্র ডেভিস কাপ থাকবে না তা কি করে হয়। সেটাই সম্ভব করে তুললেন ফেদেরার।
বেইজিংয়ে ২০০৮ সালে অলিম্পিক স্বর্ণ পদকটি এসেছিল স্ট্যানিসলাস ওয়ারিঙ্কাকে সঙ্গী করে ডাবলসে। যদিও এতসব অর্জনের পরেও এখনো তিনি রাফায়েল নাদাল এবং আন্দ্রে আগাসীর কৃতিত্বকে ধরতে পারেননি। এই দুজনই চারটি গ্র্যান্ড স্ল্যামের পাশাপাশি অলিম্পিক এককে স্বর্ণ এবং ডেভিস কাপের শিরোপা জিতেছেন বেশ অনায়াসেই। কিন্তু সবকিছুর পরেও সর্বকালের সেরা টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে একজন খেলোয়াড়কে বিবেচনা করতে হলে সেখানে অনেক কিছুই দেখা হয়, যার সব গুনই ফেদেরারের মধ্যে রয়েছে। সব শিরোপার মধ্যে ফেদেরারের কাছে ডেভিস কাপ জয়ই সবচেয়ে কঠিন, কারন এখানে ব্যক্তিগত পারফরমেন্সের পাশাপাশি সতীর্থদের সাফল্যের উপরও নির্ভর করতে হয়।
২০০৩ সালে প্রথমবারের মত উইম্বলডনের শিরোপা জেতা এর রোববার সুইজারল্যান্ডের হয়ে ফ্রান্সের বিপক্ষে ফাইনালে জয়ী হয়ে ডেভিস কাপের শিরোপা কোনটা বেশী স্মরণীয় এমন প্রশ্নের উত্তরে অবশ্য ফেড এক্স বলেছেন, ‘এখানে তুলনা করার কিছু নেই। যখন আমি উইম্বলডন জিতেছিলাম তখন সত্যি বলতে কি একেবারে বিস্মিত হয়ে পড়েছিলাম। ডেভিস কাপ সম্পর্কে আমার একটি আত্মবিশ্বাস ছিল ক্যারিয়ারের কোন না কোন সময় আমি এই শিরোপা জিতবই। অবশ্যই সবকিছুকে মানিয়ে নিয়ে শিরোপা অর্জন করার একটি চাপ তো থাকেই, এবং একটি দল হিসেবে এখানে সবাইকে খুশী করারও একটি বিষয় থাকে। তাই এই অনুভূতিটা একেবারে ভিন্ন। আমি এখানে একা খেলিনি। তাই সবকিছুই পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল।’
প্রথম পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে ফেদেরার গাসটাডের সুইস স্কি রিসোর্টে ১৯৯৮ সালে টুর্ণামেন্টে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ৩২তম রাউন্ডে পরাজিত হন। বিশ্বের সর্বকালের সেরা জুনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে তিনি তার সময়ে বিবেচিত হয়েছিলেন। তখন অবশ্য সত্যিকার অর্থেই কোন ইঙ্গিত ছিল না পেশাদার জীবনে এসে টেনিস বিশ্ব তাকে কোন অবস্থায় দেখবে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক টেনিস তারকা পিট স্যাম্প্রাস যুগে মূলত অন্য কোন খেলোয়াড়ের দিকে কোন নজড়ই ছিল না। কিন্তু ২০০১ সালে উইম্বলডনের চতুর্থ রাউন্ডে পাঁচ সেটের লড়াইয়ে পিটকে পরাজিত করার পরেই প্রথম ফেদেরারের উপর সকলের দৃষ্টি পড়ে। তারপরে অবশ্য গ্র্যান্ড স্ল্যাম ইভেন্টে ফেদেরার প্রায়ই ব্যর্থ হয়েছিলেন। বিশেষ কওে ২০০৩ সালে ফ্রেঞ্চ ওপেনের প্রথম রাউন্ডে লুইস হোরনার কাছে পরাজিত হওয়াটা তার ক্যারিয়ারের একটি কালো অধ্যায়।
ফেদেরার যে সময় তার ক্যারিয়ারকে সমৃদ্ধ করেছিলেন সেই সময়ে তার সাথে বেশ কয়েকজন উঠতি তারকা উত্থান হয়েছিল যাদের মধ্যে লেটন হিউয়েট, এন্ডি রডিক, মারাত সাফিন অন্যতম। তার সতীর্থরা যেখানে র্যাঙ্কিংয়ের উন্নতি থেকে গ্র্যান্ড স্ল্যাম শিরোপা জিততে থাকেন সেখানে ফেদেরারের সাফল্য হয়ে পড়ে অনিয়মিত। পরের বছরই ফেদেরার বলেছিলেন, আমি হতাশ এ কথাটা কখনই বলতে চাইনা। কিন্তু আমি সত্যিকার অর্থেই বুঝতে পারছিনা কেন আমার সাথেই এমন হচ্ছে। এই ধরনের পারফরমেন্সের সাথে আমাকে মানায় না। হয়ত আমাকে আরেকটু বেশী পরিশ্রম করতে হবে।
প্যারিসে ব্যর্থ হবার একমাস পরেই নতুন রূপে যেন আবির্ভূত হন সুইস তারকা। উইম্বলডনের ফাইনালে সরাসরি সেটে মার্ক ফিলিপোসিসকে হারিয়ে তার যাত্রা শুরু। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি টেনিস বিশ্বের এই উজ্জ্বল প্রতিভাকে। পরবর্তী চার বছরে টেনিস বিশ্ব ফেদেরারের দোর্দন্ড প্রতাপ দেখেছে। ১০টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম শিরোপা জিতে তিনি প্রমান করেছেন কেন তিন বিশ্ব সেরা। এর মধ্যে ২০০৪ ও ২০০৭ সালে চারটির মধ্যে তিনটি গ্র্যান্ড স্ল্যামই ছিল তার দখলে। এর মধ্যে শুধুমাত্র স্প্যানিশ ক্লে কোর্ট বিশেষজ্ঞ রাফায়েল নাদাল ফেদেরারের পাশে নিজেকে কিছুটা সামনে নিয়ে আসেন ফ্রেঞ্চ ওপেন শিরোপা জয়ের মাধ্যমে। একমাত্র নাদালকেই পুরো ক্যারিয়ারে ফেদেরার তার সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ২০০৯ সালে রবিন সোদারলিংয়ের কাছে নাদাল রোলা গ্যাঁরোতে পরাজিত হবার পরে ফেদেরার শেষ পর্যন্ত এই টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতে গ্র্যান্ডস স্ল্যামের কোটা পূরণ করেণ। এই সময়ের মধ্যে তিনি ওয়ারিঙ্কাকে নিয়ে ২০০৮ সালে অলিম্পিক স্বর্ণ, ২০১২ সালে উইম্বলডন জিতে সর্বকালের সেরা ১৭টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের রেকর্ড গড়েন।
কিন্তু তারপরেও ডেভিস কাপের আক্ষেপ রয়েই গিয়েছিল ৩৩ বছর বয়সী ফেদেরারের। বছরের শুরুতে ওয়ারিঙ্কা অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জয়ের পরপরই দুই বন্ধু মিলে ডেভিস কাপের শিরোপা জয়ের লক্ষ্য স্থির করেন। প্রথম রাউন্ডে তারা নোভাক জকোভিচ বিহীন সার্বিয়াকে পরাজিত করেন। এরপর কোয়ার্টার ফাইনালে কাজাকাস্তান এবং সেমিফাইনালে সহজেই ইতালিকে পরাজিত করে ফাইনাল নিশ্চিত করেন। ফাইনালে প্রতিপক্ষ হিসেবে ফ্রান্স তুলনামূলক কিছুটা শক্তিশালী ছিল। জো-উইলফ্রিড সোঙ্গা, গায়েল মনফিলসকে নিয়ে গঠিত ফ্রেঞ্চ দলের বিপক্ষে লড়াইটা যে খুব একটা সহজ হবে না তা ছিল অনুমেয়। কিন্তু সবকিছুকে পিছনে ফেলে বছর শেষের এই কৃতিত্ব পুরো দলের পাশাপাশি ফেদেরারকে দারুন উদ্বেলিত করে তুলেছিল। ম্যাচ শেষে কোর্টে সতীর্থদের জড়িয়ে আবেগ আপুøত হয়ে পড়েছিলেন ফেদেরার। ১৫ বছর পরে প্রথম কোন শিরোপা জয়ে এমন আবেগই তো স্বাভাবিক।
