বিশ্বের একমাত্র আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর মংলার পণ্য পরিবহনে নেই রেল যোগাযোগ। সেই দুর্নাম ঘুচতে যাচ্ছে এবার। মংলা বন্দরের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে রেল। লোকসানের ভারে বন্ধ হতে চলা দেশের দ্বিতীয় এই সমুদ্রবন্দরটিকে সরকার সচল করায় কয়েক বছর ধরে মুখ দেখছে লাভের। এরই ধারাবাহিকতায় রেলপথের মাধ্যমে সার্ক ট্রানজিটের আওতায় প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে মংলা বন্দরের রেল যোগাযোগ স্থাপনে ২০১০ সালে খুলনা-মংলা রেল প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এ প্রকল্পের কাজ চলছে এখন পুরোদমে। দীর্ঘ ৬৪ কিলোমিটার এই রেলপথের বড় বাধা খরস্রোতা রূপসা নদী। একই সঙ্গে রূপসার ওপর রেলসেতু নির্মাণে চলছে মহাকর্মযজ্ঞ। ২০১৯ সালের মধ্যেই চালু হবে খুলনা-মংলা রেলপথ। মংলা বন্দর থেকে এ রেলপথটি ৬৪ কিলোমিটার দূরে খুলনার ফুলতলায় গিয়ে যুক্ত হবে। রেলপথটি চালুর ফলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানসহ সার্ক ট্রানজিটের আওতায় মংলা বন্দরের পণ্য সরাসরি পরিবহন হবে প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটানে— এমনটাই আশা করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে ও মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি এটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ অর্থায়নে ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ খুলনা-মংলা রেলপথটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৩ হাজার ৮০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে রূপসা রেলসেতু নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৭৬ কোটি টাকা। ২০১০ সালে অনুমোদিত এ প্রকল্পে ইতিমধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ ও ১৪ কিলোমিটার রেলপথের মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে। অবশিষ্ট রেলপথের মাটি ভরাটের কাজও শুরু হয়েছে। ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লারসন অ্যান্ড টার্বো লিমিটেড ৫ দশমিক ১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ রূপসা রেলসেতুর কাজ শুরু করে দিয়েছে। খুলনা শহরতলির লবণচোরা পয়েন্ট দিয়ে রূপসা রেলসেতুর পিলার স্থাপনের কাজ পুরোদমে চলছে। একই সঙ্গে এ রেলপথে ২১টি ছোট-বড় ব্রিজ ও ১১০টি কালভার্ট নির্মাণের কাজও চলছে। ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ভূমি অধিগ্রহণ ও ঠিকাদার নিয়োগে বিলম্বের কারণে ২০১৯ সালে শেষ হবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সরেজমিন রূপসা রেলসেতু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, চারদিকে ঠুনঠান শব্দ। সেতুর পিলার নির্মাণে চলছে ঢালাইয়ের কাজ। লারসন অ্যান্ড টার্বো লিমিটেডের কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার জ্যোতিন্দর সিং জানান, এক বছরের মধ্যে রূপসা রেলসেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে। এজন্য প্রকৌশলীসহ শ্রমিকরা দিন-রাত কাজ করে চলেছেন। বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন খুলনা-মংলা রেল প্রকল্পের বিষয়ে জানান, এ রেলপথ ও রূপসা রেলসেতু নির্মাণ পুরোদমে চলছে। ইতিমধ্যে ৩১ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী বছরের জুনের মধ্যে খুলনা-মংলা রেলপথের টেক-অফ পয়েন্ট খুলনা ফুলতলা দিয়ে রূপসা রেলসেতু পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটারের কাজ শেষ করে আংশিক উদ্বোধন করা হবে। তবে আগামী অর্থবছরের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ভূমি অধিগ্রহণ ও ঠিকাদার নিয়োগে বিলম্বের কারণে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না। প্রকল্পটি ২০১৯ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ রেলওয়ে দেশের অভ্যন্তরে পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি সার্ক ট্রানজিটের আওতায় ভারত, নেপাল ও ভুটানে মংলা বন্দরে খালাস হওয়া পণ্য পরিবহন করবে।
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ভারতের সঙ্গে আমাদের পেট্রাপোল-বেনাপোল, গেদে-দর্শনা, সিঙ্গাবাদ-রহনপুর ও রাধিকাপুর-বিরল দিয়ে রেলপথ যোগাযোগ রয়েছে। ’ মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. জহিরুল হক জানান, এ বন্দরে খালাস পণ্যের পুরোটাই এত দিন নৌ ও সড়কপথে পরিবহন করা হতো। বিশ্বের একমাত্র আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর, যার সঙ্গে ছিল না কোনো রেল যোগাযোগ। মংলা বন্দরের সঙ্গে রেল যোগাযোগ ছিল স্বপ্ন। এত দিন মংলা বন্দরের দুঃখ ছিল রেলপথ না থাকা। কিন্তু মংলা বন্দরের সঙ্গে রেলপথের স্বপ্ন আজ বাস্তবায়ন হতে চলেছে। গত অর্থবছরে মংলা বন্দরে ৬০০ জাহাজ হ্যান্ডলিং করে লাভ হয়েছে ১৮৮ কোটি টাকা। রেলপথ চালু হলে এ বন্দর বছরে ৬ হাজার জাহাজ হ্যান্ডলিং করতে পারবে। আর এতে বছরে বন্দর ১ হাজার কোটি টাকার বেশি লাভ করবে। তিনি বলেন, ‘আগে আমাদের পণ্য পরিবহনে সড়ক ও নৌপথের ওপর নির্ভর করতে হতো। প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটান মংলা বন্দর ব্যবহারে আগ্রহ প্রকাশ করলেও রেলপথ না থাকায় তা সম্ভব হয়নি। রেলপথ চালু হলে এ তিনটি দেশে মংলা বন্দরে খালাস পণ্য পরিবহন একদিকে যেমন সহজতর হবে, অন্যদিকে আমদানি-রপ্তানিকারকরা কোনো জাহাজ-জট ছাড়াই খুব সহজে এ বন্দর দিয়ে পণ্য খালাস ও পরিবহন করতে পারবেন। এর ফলে বন্দরে জাহাজের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে মংলা বন্দর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে একদিকে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপনসহ জাতীয় অর্থনীতি এবং এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় এটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
বাগেরহাট নাগরিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও বাগেরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি সরদার আনসার উদ্দিন বলেন, ‘রেলপথ চালু হলে শুধু মংলা বন্দরেরই লাভ হবে না, আমাদের জাতীয় অর্থনীতিও শক্তিশালী হবে। দেশের পিছিয়ে পড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্প-কারখানা স্থাপনসহ বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হবে। ’ একই সঙ্গে বাগেরহাটের কাটাখালী পয়েন্ট দিয়ে গোপালগঞ্জ হয়ে পদ্মা সেতু পর্যন্ত আরও একটি রেলপথ নির্মাণের দাবি জানান তিনি।