সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন নয় : গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব করবে ইসি : ‘না’ ভোটের প্রবর্তন
পঞ্চায়েত হাবিব :একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত এবং অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে ভোট গ্রহণে তফসিল ঘোষণার আগে সংসদ ভেঙে দেয়া, সেনা মোতায়েন, গ্রহণযোগ্য সহায়ক সরকার এবং না ভোটের বিধান পুনরায় আনাসহ বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। সহায়ক সরকার ও সেনা মোতায়েনের ব্যাপারে কেউ কেউ দ্বিমত পোষণ করলেও অধিকাংশ আলোচক নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার ইস্যুতে নির্বাচন কমিশনারদের কথা না বলা এবং ভোটারদের আস্থা অর্জনের পরামর্শ দিয়েছেন। ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী গতকাল সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইসির সংলাপে তারা এসব পরামর্শ দেন। আলোচকরা বলছেন, নির্বাচনকালীন সময়ে সংসদ ভেঙে দেয়াটা জরুরি। তা করা না হলে তিন শ’টি ক্ষমতার বলয় স্ব স্ব আসনে এমপিদের নির্বাচনকে প্রভাবিত করার সুযোগ থেকে যাচ্ছে। তাই সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন আয়োজন না করে ইসিকে এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে সংসদ ভেঙে দেয়ার পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দেন। এ ছাড়াও ভোটের আগে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের ওপর ইসির কর্তৃত্ব রাখার প্রস্তাব কমিশনকে দেন।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার সভাপতিত্বে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার শুরুতে সিইসি কে এম নূরুল হুদা স্বাগত বক্তব্য দেন। এ সময় চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভা সঞ্চালনা করন ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। সংলাপে ইসির পক্ষ থেকে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, আইনজীবীসহ বিভিন্ন মহলে যাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে; এমন ৫৯ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও অংশ নেন ৩০ জন। এদিকে অনুষ্ঠান স্থলে সাংবাদিকদের ছবি তোলার অনুমতি দেয়া হলেও সংলাপের সময় কাউকে থাকতে দেয়া হয়নি। যদিও বিগত দুই কমিশনের আমলে এ ধরনের সংলাপে সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
সংলাপে অংশ নিয়ে সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, নির্বাচনের জন্য সহায়ক সরকার দরকার। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। নির্বাচনে ভয়মুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে সেনা মোতায়েন করতে হবে। নির্বাচনের আগে বর্তমান সংসদ ভেঙে দিতে হবে। এ বিষয়ে সুশীল সমাজের বেশির ভাগ প্রতিনিধি ঐকমত্য পোষণ করেছেন নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে বর্তমান সরকার থাকবে না-কি অন্যরা থাকবে। তবে এ সময়ে সংসদ ভেঙে দেয়াটা জরুরি। না হলে তিন শ’টি ক্ষমতার বলয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করার সুযোগ থেকে যাচ্ছে। ওই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের ওপর ইসির কর্তৃত্বটা রাখা খুবই জরুরি। ইভিএম নিয়ে বিতর্ক করে সময় ব্যয় না করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তিনি আরো বলেন, সবাই খোলামেলা মত দিয়েছেন। অনেক বিষয় মতৈক্যের মতো হয়েছে, কিছু বিষয় নিয়ে ভিন্নমত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন নিজে সক্রিয় হওয়া, নিকট অতীতে দেখেছি, ইসি নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগে অনীহা দেখিয়েছে। যেটা সুষ্ঠু নির্বাচন অর্জনে কাজ দেয়নি। ইসি নিজে যেন সক্রিয় হয়। তিনি বলেন, আমরা লিখিত মতামতও দিচ্ছি। রিটার্নিং অফিসারের নিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে নিজস্ব লোকও হতে পারেন, অথবা ইসির চিহ্নিত জেলা প্রশাসকও হতে পারেন। একজন্য ইসির সক্ষমতা বাড়াতে হবে। অভিযোগ আমলে নেয়া হয় না বা প্রতিকার নেই। এটাতে সক্ষমতা প্রমাণ হয় না। এ জন্য সক্ষমতা দেখানো জরুরি। অভিযোগ আমলে নিয়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে অনেক অনিয়ম রোধ হতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, সেনাবাহিনীকে যদি ফিলিং স্টেশন, রাস্তা নির্মাণের কাজে ব্যবহার করা যায়, তাহলে কেন নির্বাচনে দায়িত্ব পালনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে সবাই নির্বাচনে আসতে পারে। প্রার্থী ও পোলিং এজেন্টদের ভয় দূর করতে হবে। না ভোট প্রসঙ্গে আসিফ নজরুল বলেন, না ভোট যেন রাখা হয়। পৃথিবীর অনেক দেশে না ভোট আছে। তিনি বলেন, বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচনের কোনো সুযোগ যেন না থাকে। আসিফ নজরুল আরো বলেন, ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করা যায় কি-না বিবেচনা করার জন্য বলা হয়েছে। যেহেতু ডিসিরা রিটার্নিং অফিসার থাকেন, সেক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারের সময়ে সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের বাদ দেয়া যেতে পারে।
স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচন হচ্ছে সুপার পলিটিক্যাল ইভেন্ট। এ নির্বাচনের মাধ্যমে দলগুলো ফল ঘরে তোলে। কিন্তু এখনকার সঙ্কট দূর করে নির্বাচনী কৌশলে আসতে হবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনী দায়িত্বপালনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা, নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো, নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা পুনরুদ্ধার করার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এসব বিষয়ে বেশির ভাগ প্রতিনিধি ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। তিনি বলেন, ইসিকে জনমানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। ইসি দৃঢ় এবং স্বাধীন ভ‚মিকায় আছে এটা দৃশ্যমান হতে হবে। এটি সবচেয়ে বড় কাজ। দেবপ্রিয় বলেন, কিছু বিষয়ে আইনের দুর্বলতা আছে। সেগুলো সংস্কার করে ঘাটতিগুলো পূরণ করতে হবে। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় ধর্মের বিষয় একেবারেই রাখা যাবে না। এ ব্যাপারেও সুশীল সমাজের বেশির ভাগ প্রতিনিধি ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। নির্বাচনী প্রচারণার ব্যয় সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বচ্ছতা আনতে হবে। এ জন্য ইসিকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আরেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন আহমেদ খান বলেন, যেসব আইনে দুর্বলতা আছে, সেগুলো আইন সংস্কার করা দরকার। ইসির উচিত সরকারকে বলা তারা কী করতে চায়। এ ছাড়া তারা বলে যে, তফসিল ঘোষণার আগে কিছু করার নেই। এই কথাটি ঠিক না। এ বিষয় নিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য তাদের কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। যারা অভিবাসী তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য কমিশনকে উদ্যোগ নিতে হবে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. ওয়ালিউর রহমান বলেন, আলোচনায় মূল ফোকাসটা দেয়া হয়েছে- অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে। আমরা যেন সবার অংশগ্রহণে ভোট দেখতে পাই। সহায়ক সরকারই তত্ত¡াবধায়ক সরকার। অনেকে বলেছে, তত্ত¡াবধায়ক সরকার আনা হোক, আমরা বলছি- এটা আনা সম্ভব না, এটা ডেড ইস্যু। আর্মি নিয়ে আসার কথা বলা হচ্ছে- আমরা বলেছি, তাদের ম্যাজিস্ট্রেশিয়াল পাওয়ার দেয়া ঠিক হবে না, আর্মিকে ভোটে আনার দরকার নেই। পার্লামেন্টে ভেঙে দেয়ার কথা তুলেছে- আমরা বলেছি, ভেঙে দেয়া যাবে না।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ দরকার। প্রশিক্ষণ থাকলে ৭৫ শতাংশ অনিয়ম দূর করা সম্ভব। কমিশনের ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিবন্ধী ও বেদে স¤প্রদায়ের চাহিদা ও বিশেষ প্রয়োজন মিটিয়ে নির্বাচনে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. অধ্যাপক তাসনীম আরিফা সিদ্দিকী বলেন, নির্বাচন কমিশনের কাজই জনগণের মতকে তুলে ধরা। সেটা করতে গিয়ে বাধা আসবেই। ইসি যদি জনগণের অধিকার রক্ষায় কাজ করে, তাহলে জনগণ তাদের পছন্দ করবে। নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ভোটে সেনা মোতায়েন করার কথা এলেও তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়ার কথা ওঠেনি। ইসি সঠিকভাবে কাজ করলে কোনো রাজনৈতিক দলই তাদের পছন্দ করবে না। তবে জনগণকে তারা পাশে পাবে।
নাগরিক সমাজের আমন্ত্রিত প্রতিনিধিদের মধ্যে সংলাপে অন্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, সাবেক সচিব এ এইচ এম কাশেম, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, সাবেক রাষ্ট্রদূত এ এফ গোলাম হোসেন, সাবেক সচিব রকিব উদ্দিন মন্ডল, অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, অধ্যাপক অজয় রায়, অধিকারকর্মী খুশী কবির, সাইফুল হক, সঞ্জীব দ্রং, ফিলীপ গায়েন, ব্রতীর নির্বাহী শারমিন মুর্শিদ, অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, কলাম লেখক মহিউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক মাহবুবা নাসরিন, কবি লুবানা হাসান, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান সা’দত হুসাইন প্রমুখ।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করতে গত ১৬ জুলাই দেড় বছরের কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করে কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এর অংশ হিসেবে রাজনৈতিক দল, নির্বাচন পরিচালনা বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যম প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক ও নারী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইসির এই মতবিনিময়।