রামপাল প্রকল্প এগিয়ে নিতে ইউনেসকোর কাছ থেকে ছাড় পাওয়া গেছে বলে সরকার যে দাবি করেছিল, প্রকাশিত সিদ্ধান্তে তার উল্লেখ নেই। পোল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সুন্দরবন ও রামপাল বিষয়ে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের ৪১তম সভার সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন গতকাল রোববার প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রভাব নিয়ে সুন্দরবন এবং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে একটি কৌশলগত পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (এসইএ) করতে অনুরোধ করেছে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থার (ইউনেসকো) বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র।
এই সমীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই অঞ্চলে কোনো বৃহদাকার শিল্প অবকাঠামো নির্মাণ না করতে অনুরোধ জানিয়েছে সংস্থাটি। ফলে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক সংস্থাটি যেসব আপত্তি তুলেছিল, সেগুলো বহাল রইল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে রামপাল প্রকল্প এগিয়ে নিতে ছাড় পাওয়া গেছে মর্মে সরকার যে বক্তব্য দিয়েছিল, সেটি সঠিক নয়।
১২ জুলাই বৈঠক শেষ হলেও ওই বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ পাওয়া গেল ১৮ দিন পর। তবে বৈঠক চলাকালেই এটির সিদ্ধান্ত জানিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৭ জুলাই একটি বিজ্ঞপ্তি দেয়, যাতে দাবি করা হয়, ২ জুলাইয়ের অধিবেশনে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপারে ইউনেসকো তাদের আপত্তি তুলে নিয়েছে এবং সুন্দরবনের নাম বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তির যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী পোল্যান্ডের ক্র্যাকো শহরের ওই বৈঠক থেকে দেশে ফিরে ১০ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, আপাতত সুন্দরবনের পাশে বড় ধরনের শিল্প অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি সরকার দেবে না, তবে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ বন্ধ হচ্ছে না। তিনি বলেন, ইউনেসকোর সুপারিশ ভবিষ্যতের অবকাঠামোর জন্য বলা হয়েছে। রামপালের কাজ যেহেতু আগে থেকেই শুরু হয়েছে, ফলে রামপালের জন্য তা প্রযোজ্য নয়।
বৈঠকের ৭ নম্বর সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে ইউনেসকোর রিঅ্যাক্টিভ মনিটরিং মিশন যেসব সুপারিশ করেছিল, সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে ইউনেসকো ২০১৬ সালের মার্চে একটি রিঅ্যাক্টিভ মনিটরিং মিশন পাঠায়। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত দলটি সুন্দরবন এলাকায় সমীক্ষা চালিয়ে যে প্রতিবেদন দেয়, তাতে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করার সুপারিশ করা হয়েছিল।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জ্বালানি, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ইউনেসকোর মূল আপত্তি ছিল রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে। তারা খসড়া সিদ্ধান্তে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবি রেখেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের যুক্তিতর্কে সন্তুষ্ট হয়ে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি রামপাল প্রকল্পের ব্যাপারে তাদের আপত্তি তুলে নিয়েছে। ফলে এখন আর রামপাল প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যেতে বাধা নেই।
তবে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব আনু মুহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকার ইউনেসকোর সভায় গিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত মানার অঙ্গীকার করে এসেছে।
এখন ইউনেসকোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে বলা হচ্ছে, রামপাল কেন, সুন্দরবনের পাশে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানই করা যাবে না। সরকার যদি জাতিসংঘের এই সংস্থার সিদ্ধান্ত মানে, তাহলে অবশ্যই রামপালের কাজ বন্ধ করতে হবে। আর সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে রামপাল প্রকল্পে ইউনেসকোর আপত্তি তুলে নেওয়া হয়েছে বলে যেসব বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, তা যে মিথ্যা, তা আবারও প্রমাণিত হলো। আর সুন্দরবন রক্ষা করতে হলে রামপাল প্রকল্প বাতিল করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
তবে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৪১তম সভায় পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার কিপার্স অ্যালায়েন্সের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শরিফ জামিল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ইউনেসকো রামপাল প্রকল্প নিয়ে তাদের অবস্থান রিঅ্যাক্টিভ মনিটরিং প্রতিবেদনে পরিষ্কার করেছে। সেখানে তারা রামপালসহ সুন্দরবনের চারপাশে সব ধরনের শিল্পকারখানা ও অবকাঠামো না করার সুপারিশ করেছিল। গতকাল প্রকাশিত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে রিঅ্যাক্টিভ মনিটরিং রিপোর্টের সুপারিশের বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যাবে না।
শরিফ জামিল আরও বলেন, বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভা শেষে ঢাকায় ফিরে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে ইউনেসকো রামপাল প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে বলে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা যে অসত্য, তা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেখে প্রমাণিত হলো।
প্রতিবেদনে দুই পৃষ্ঠার বাংলাদেশ অংশে যে ১১ দফা সিদ্ধান্ত তুলে ধরা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রভাব নিয়ে সুন্দরবন ও দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় একটি কৌশলগত পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (এসইএ) চালানোর যে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে, সেটি যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করে বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রে পাঠাতে হবে। এরপর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র সেটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারকে (আইইউসিএন) দিয়ে সেটি পর্যালোচনা করে নেবে।
১১ নম্বর সিদ্ধান্তে আরও বলা হয়েছে, যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির কাছে জমা দিতে হবে। কমিটির ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় ৪৩তম অধিবেশনে ওই প্রতিবেদন নিরীক্ষা করা হবে।