মাসিক তিন লাখ পিস পোশাকপণ্য (প্যান্ট) সরবরাহে ইউরোপীয় একটি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছে বাংলাদেশের এবিসি অ্যাপারেলস (ছদ্মনাম)। সমঝোতার একপর্যায়ে প্যান্টের মূল্যবাবদ পিসপ্রতি ২ সেন্ট হংকংয়ে স্থানীয় এজেন্টের ব্যাংক হিসাবে পরিশোধের দাবি তোলে কারখানা কর্তৃপক্ষ। ঋণপত্র খুলতে বলে পিসপ্রতি ২ সেন্ট বাদ দিয়ে। ছয় মাসের ক্রয়াদেশে এ পন্থায় ৩৬ হাজার ডলার হংকংয়ে পাচার করে প্রতিষ্ঠানটি।
রফতানির পাশাপাশি আমদানির মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে। গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের ওয়ানটাচ বিজনেস সেন্টার কোম্পানি থেকে বিপি শিটের ৪৭৪ টনের দুটি চালান আমদানি করে ঢাকার সিএপি ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল। আগামপত্র অনুযায়ী, একটি চালানে ১৩ কনটেইনারে ২৮৪ টন ও অন্য চালানে নয় কনটেইনারে ১৯০ টন বিপি শিট থাকার কথা। কিন্তু কায়িক পরীক্ষায় বিপি শিটের আদলে মাটির তৈরি ব্লক পাওয়া যায় এসব কনটেইনারে।
আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারকে দেশের ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় হুমকি বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা, যা উঠে এসেছে দেশের ব্যাংকারদের ওপর পরিচালিত এক জরিপেও। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৩০টি ব্যাংকের কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তাদের ওপর জরিপটি চালায় আর্থিক খাতের ভারতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফিনটেলেক্ট।
ব্যাংকিং কার্যক্রমে ব্যাংকাররা কী ধরনের চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন, তার র্যাংকিং করতে বলা হয় জরিপে অংশগ্রহণকারীদের। ৯৭ শতাংশ কর্মকর্তাই বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারকে ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় হুমকি বলে মত দেন। গ্রাহকের তহবিলের উত্স শনাক্ত করাকে চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন ৮৩ শতাংশ কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তা। গ্রাহকের একাধিক ব্যবসায়িক লেনদেন নজরদারিকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মনে করেন ৮০ শতাংশ কর্মকর্তা। করপোরেট গ্রাহকদের সুবিধাভোগী শনাক্ত করাকে ৭৭ শতাংশ কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তা বড় সমস্যা বলে মনে করেন।
বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই বড় হুমকি বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মতো যে বিষয়গুলো আমরা শুনতে পাই, সেগুলোর সবই বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার। বিষয়টি আমরা আরো আগেই উপলব্ধি করেছি। এ হুমকি রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক সচেষ্ট রয়েছে। কর্মকর্তাদের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মতো সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও এ হুমকি রোধে কাজ করছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে পণ্যের মূল্য কম বা বেশি দেখিয়ে। দীর্ঘদিন ধরে পর্যায়ক্রমে অর্থ পাচার হওয়ায় এগুলো নজরদারিও কষ্টসাধ্য। তবে বিদেশে ব্যাংক হিসাব খোলা এখন তুলনামূলক কঠিন। তাই বিদেশী স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই) হিসাবে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে ৫ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। পাচার হওয়া এ অর্থের ৮০ শতাংশের বেশি গেছে বাণিজ্যের আড়ালে।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, পরিসংখ্যানে দেখা যায়, অর্থ পাচারের বড় অংশ হচ্ছে বাণিজ্যের আড়ালে। বিভিন্ন দেশে ব্যাংক হিসাব খোলা ও সেখানে টাকা জমা দেয়া কঠিন হয়ে উঠছে। কারণ আজকাল সবাই অর্থের উত্স জানতে চায়। সাধারণত অর্থ পাচারের জন্য প্রথমে বিদেশে একটি কার্যালয় চালু করে স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমে ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। তারপর ধীরে ধীরে অর্থ স্থানান্তর করা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে সংশ্লিষ্ট সংস্থা যেমন— শুল্ক বিভাগের সক্রিয়তা আগের চেয়ে বেড়েছে। তারা বিভিন্ন পণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্যের ওপরও নজরদারি করছে। কিন্তু খুব ছোট পরিমাণে অনেক দিন ধরে যেসব অর্থ পাচার হচ্ছে, সেগুলো শনাক্ত করা কষ্টসাধ্য। তার পরও এখন নজরদারি ও সক্রিয়তা আগের চেয়ে বেড়েছে।
বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার রোধে সীমাবদ্ধতার বিষয়টিও উঠে এসেছে জরিপে। প্রযুুক্তিগত ঘাটতি অর্থ পাচার রোধের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করেন ৯০ শতাংশ কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তা। ৮৩ শতাংশ কর্মকর্তা সব গ্রাহকের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি স্থাপনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেন। অভ্যন্তরীণ নীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়াকে চ্যালেঞ্জ মনে করেন ৭৭ শতাংশ কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তা। ৫৭ শতাংশ কর্মকর্তা মনে করেন, কর্মী প্রশিক্ষণের ঘাটতি অর্থ পাচার রোধে বড় চ্যালেঞ্জ। বাজেট ঘাটতিকে অর্থ পাচার রোধের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখেন ৩৭ শতাংশ কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তা।
অর্থ পাচার রোধে কমপ্লায়েন্স ব্যয়ের অগ্রাধিকার কেমন হওয়া উচিত? এ প্রশ্নও করা হয়েছিল ব্যাংকারদের। জবাবে তথ্য হালনাগাদ ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় ব্যয়কে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত বলে মত দেন তারা। ক্রয়-সংক্রান্ত নজরদারি ব্যবস্থায় ব্যয় বৃদ্ধিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অগ্রধিকার দেন তারা। ব্যাংকারদের মতে, কমপ্লায়েন্স ব্যয়ের তৃতীয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের খাত স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা প্রণয়ন।