বুদেল্লি আইল্যান্ড। মেডিটেরিয়ান সমুদ্র অঞ্চলের সারদানিয়ার কাছেই জনমানবশূন্য এক দ্বীপ। দ্বীপটির মালিকানা নিয়ে ইতালি ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যে টানাপড়েন। ২০১৬ সালে এক ব্যবসায়ী দ্বীপটির মালিকানা নিয়ে মামলা করে বসেন। তখন খোঁজ পাওয়া গেল, দ্বীপে যে এক ‘বুড়ো’ বাস করেন—তার কী হবে? ১৮ হাজার মানুষ বুড়োর পক্ষে দাঁড়িয়ে গেল। সাদা কাগজে তারা স্বাক্ষর করলেন, দ্বীপ কারও নয়, বুড়োর! তাকে হটানো যাবে না। অগত্যা তাই হলো। যার জন্য এত কাণ্ড সে বৃদ্ধের নাম মৌরো মোরান্দি। এখন তার বয়স ৭৮। বর্তমান ঠিকানা বুদেল্লি আইল্যান্ড। দ্বীপটি মেডালিনা ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্ভুক্ত হলে, মৌরো মোরান্দিও তাই। সে কথাই থাকল।
মোরান্দির গল্প শোনার আগে বুদেল্লি দ্বীপের কথা শোনা যাক। গোলাপের মতো বালুকাবেলা থাকায় এই দ্বীপকে বলা হয় ‘গোলাপি দ্বীপ’। নীল জলরাশির উচ্ছ্বাসে মন মাতানো এই দ্বীপের প্রাণী ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য অনন্য। তবে নব্বইয়ের পর থেকেই বিপর্যয় দেখা দেয়। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় দ্বীপে মানুষের চলাচল বন্ধ রাখা হয়। ক্ষয়প্রাপ্ত দ্বীপ বলে একে এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। কারণ আর কিছুই নয়— প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ১৯৮৯ সালে অপরূপ এই দ্বীপের প্রেমে পড়েন মৌরো মোরান্দি। ছোট ভেলা নিয়ে মাছ ধরতে ধরতে ভেসে এসেছিলেন তিনি। খাবার পানি পেতে এই দ্বীপে নেমেছিলেন। পুরনো ভেলার মালিক মোরান্দিকে বললেন, ‘এ ভেলার সবটাই অকেজো। তুমি চাইলে রাখতে পার। ’ মোরান্দি আর শহরে ফিরলেন না। সুনসান নীরবতায় বাকি জীবনটা এখানেই কাটাবেন বলে ঠিক করলেন। যা ভাবা তাই কাজ। বুড়োর ভীমরতি বলে শুরুতে অনেকে কটাক্ষ করলেন। সেসব পাত্তা দিলেন না। গাছের পাতা দিয়ে ছাউনি বাঁধলেন ঘরের। একটা বারান্দার মতো জায়গায় শুয়ে-বসে বই পড়েন আর সমুদ্রের ঢেউয়ের সংগীত শোনেন। জোছনামাখা সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়েই বুঝি জানলেন, ‘এ তো বন্দী জীবন, অপূর্ব এই সৌন্দর্যে আমি বন্দী!’ ভীষণ পড়ুয়া এই বৃদ্ধ দিন-রাত বই পড়েন। দুই সপ্তাহ পরপর তার এক শুভাকাঙ্ক্ষী তাকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দ্বীপে পৌঁছে দিয়ে যায়। তিনি গোটা দ্বীপের গাছপালার যত্ন নেন। প্রাণীদের দেখভাল করেন। ধর্মকর্মেও আগ্রহী তিনি। ধ্যান করেন। আর দ্বীপের সৌন্দর্যে চোখ ভরেন, মন ভরেন। এভাবেই একদম একা তার কেটে গেল ২৮টি বছর! সম্প্রতি তার গল্প তুলে আনে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন। সেখানে তিনি বলেন, আমি মৃত্যুর আগে এ দ্বীপ ছেড়ে যাব না। কেন এই দ্বীপে থাকেন? উত্তরে বলেন, এই দ্বীপের রূপই হলো নীরবতা। সুনসান নীরবতার প্রেমেই তিনি মশগুল। একা একা ২৮ বছর এই দ্বীপে কাটিয়ে জীবন সম্পর্কে তার উপলব্ধি হলো— মানুষ নিজেকে মহান (সুপার হিউম্যান) ভাবে, আসলে তারা কিছুই নয়। মোরান্দি প্রত্যাশা করেন, এক দিন গোটা পৃথিবীর মানুষ বুঝবে, প্রকৃতিপ্রেমই আসল প্রেম, আসল ধর্ম।