টালমাটাল পাকিস্তান। এলোমেলো হয়ে গেছে সবকিছু। ‘রাজনীতির ভূমিকম্পে’ কাঁপছে চারপাশ। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে সুপ্রিম কোর্টের অযোগ্য ঘোষণা, তারপর তিনি পদত্যাগ করায় বিশ্ব তাকিয়ে আছে পাকিস্তানের দিকে। বৃটিশ উপনিবেশ থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে এ দেশটি। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত সেখানকার কোনো একজন প্রধানমন্ত্রীই তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। ফলে সেখানকার ভঙ্গুর গণতন্ত্র ও তার ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। পানামাগেট কেলেঙ্কারিতে গতকাল ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট। ক্ষমতায় থাকা একজন প্রধানমন্ত্রীকে তারা ক্ষমতাচ্যুত করেছে। ফলে নওয়াজ শরীফেরও রেকর্ড গড়া হলো না। তিনিও পারলেন না মেয়াদ পূর্ণ করা প্রথম প্রধানমন্ত্রী হতে। এ নিয়ে তিনবার তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা হারালেন। তার বিরুদ্ধে রায়ে বিচার বিভাগের স্বকীয়তা, দৃঢ়তার প্রকাশ পেয়েছে। রায়ে তাকে শুধু প্রধানমন্ত্রী পদে অযোগ্যই ঘোষণা করা হলো এমন নয়। একই সঙ্গে তাকে পার্লামেন্ট নির্বাচনেও অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। একই রায়ে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে অর্থমন্ত্রী ইসহাক দার, জাতীয় পরিষদ সদস্য ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ সাফদারকে। আর মাত্র এক বছর পরেই পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন। নওয়াজ যুগ শেষ হওয়ার পরে সে পর্যন্ত একজন অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেয়া নিয়ে জোর তৎপরতা চলছিল গতকাল। উল্লেখ্য, পানামাগেট কেলেঙ্কারির মামলার চূড়ান্ত রায় স্থানীয় সময় গতকাল দুপুর ১২টার সামান্য পরেই ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট। ৫ বিচারকের সমন্বয়ে সুপ্রিম কোর্টের এ বেঞ্চের বিচারকরা হলেন, বিচারপতি আসিফ সাঈদ খোসা, ইজাজ আফজাল খান, গুলজার আহমেদ, শেখ আজমত সাঈদ, ইজাজুল আহসান। তারা সর্বসম্মতিক্রমে ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রায় ঘোষণার আগে আদালতকক্ষ ও এর আশপাশের এলাকা, রাজধানী ইসলামাবাদ, রাওয়ালপিন্ডি ও অন্যান্য স্থানে নেয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা। রেড জোন হিসেবে খ্যাত কূটনৈতিক এলাকা সিল করে দেয়া হয়। শুধু যাদের পরিচয়পত্র আছে তাদের চেক করে ওই এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হয়। সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে ও রেড জোনে পুলিশকে সহায়তা করতে মোতায়েন করা হয়েছিল রেঞ্জারস ও ফ্রন্টিয়ার কনস্টেবুলারির সদস্যদের। রায় শুনতে আদালতে উপস্থিত হন রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সাংবাদিক, বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী। জনাকীর্ণ আদালতে বিচারপতি ইজাজ আফজাল খান ঘোষণা করেন, মিঞা মোহাম্মদ নওয়াজ শরীফকে অযোগ্য ঘোষণা করে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন প্রজ্ঞাপন জারি করবে। তাতে বলা হবে নওয়াজ শরীফ পার্লামেন্ট নির্বাচনের অযোগ্য এবং তা অবিলম্বে কার্যকর হবে। তিনি প্রধানমন্ত্রী পদেও অযোগ্য। এ মামলায় নওয়াজ শরীফ ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, নওয়াজ শরীফ পার্লামেন্ট ও আদালতে অসততা দেখিয়েছেন। রায় ঘোষণার সময় বিচারপতি ইজাজ আফজাল খান বলেন, সুপ্রিম কোর্ট গঠিত জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিম (জেআইটি) নওয়াজ শরীফ পরিবারের আর্থিক বিষয়ে তদন্ত করে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছে তা ৬ সপ্তাহের মধ্যে পাঠিয়ে দেয়া হবে জবাবদিহিতা বিষয়ক আদালতে। এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজসহ তার অর্থমন্ত্রী ইসহাক দার, জাতীয় পরিষদ সদস্য ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ সাফদার, নওয়াজের মেয়ে মরিয়ম নওয়াজ, দুই ছেলে হাসান নওয়াজ ও হোসেন নওয়াজের বিরুদ্ধে মামলা চালু করা হবে। ৬ মাসের মধ্যে এ বিষয়ক শুনানির পর রায় ঘোষণা করা হবে। এই রায় বাস্তবায়নের বিষয়টি দেখাশোনা করবেন একজন বিচারপতি। উল্লেখ্য, অর্থমন্ত্রী ইসহাক দারকে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ থাকার দায়ে পদচ্যুত করার নির্দেশ দিয়েছে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন। গতকাল রায় ঘোষণা করে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করার জন্য বিচারকরা প্রশংসা করেছেন জেআইটির। শুক্রবার সকাল থেকেই সবার চোখ ছিল ইসলামাবাদে অবস্থিত সুপ্রিম কোর্টের ১ নম্বর কক্ষের দিকে। সেখানে স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১১টায় রায় ঘোষণার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা প্রায় আধা ঘণ্টা বিলম্বে শুরু হয়। এর আগে পানামাগেট কেলেঙ্কারি মামলার রায় দেন সুপ্রিম কোর্টের ওই ৫ জন বিচারপতি। তারা বিভক্ত রায় দেন ২০শে এপ্রিল। এর ফলে আদালত জেআইটি গঠন করে আরো তদন্তের নির্দেশ দেন। সেই তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার পর গতকাল সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্ত রায় দিলেন। এখন পাকিস্তানের পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে নওয়াজের পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএলএন)-এর। রায় ঘোষণার পর তারা একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী বাছাই করতে জোর তৎপরতা শুরু করেছে। রায়ে নওয়াজ শরীফের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ অর্থমন্ত্রী ইসহাক দারকে বরখাস্ত করা হয়েছে। পাকিস্তানে দ্রুততার সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে গত এক দশকে। এজন্য কৃতিত্ব দেয়া হয় ইসহাক দারকে।
গত কয়েকদিন ধরে পাকিস্তানকে গ্রাস করেছিল একটিই আলোচনা। তা হলো নওয়াজ শরীফ অযোগ্য হতে পারেন। গত শুক্রবারই এ মামলার রায় ঘোষণার কথা ছিল। কিন্তু বিচারকরা ওইদিন রায় দেন নি। তারা শুধু বলেছিলেন, নওয়াজ শরীফের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। তবে রায় জানানো হবে আরো পরে। এর পর থেকেই শুরু হয় অপেক্ষা। যতই সময় যায়, গুঞ্জন, গুজব ততই ডালপালা মেলতে শুরু করে। এ সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে আলোচনা চলতে থাকে তা হলো প্রধানমন্ত্রীকে উৎখাত করা হবে নাকি না। এরই মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করার ঘোষণা দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খান। খবর ছড়িয়ে পড়ে, ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি নওয়াজ শরীফের সঙ্গে ৩৫ বছরের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেবেন। এ কারণে, কেন্দ্রীয় ৩ জন মন্ত্রী ছুটে যান তার কাছে। তাকে সংবাদ সম্মেলন থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করেন। অবশেষে সেই সংবাদ সম্মেলন স্থগিত করেন নিসার আলী। গতকাল শুক্রবার রায় ঘোষণার আগে বৃহস্পতিবার রাতে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। ঘোষণা দেন পার্লামেন্টের আসন থেকে পদত্যাগ করবেন তিনি। ওদিকে গতকাল রায় ঘোষণার আগে নওয়াজের মন্ত্রিপরিষদের কয়েকজন সদস্য বলেছেন, ক্ষমতাসীন দল সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে নেবে। এদিন আদালত প্রাঙ্গণে সমবেত হন বিরোধী দল পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ (পিটিআই)-এর বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী। তারা এ সময় ‘গো নওয়াজ গো’ বলে স্লোগান দিতে থাকে। নওয়াজের দলের রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকে। পিটিআইয়ের এক সদস্য জাহাঙ্গীর খান তারিন বলেছেন, পাকিস্তানের মানুষ আজ বাস্তবিকই সুবিচার পেয়েছে। পাকিস্তানে উন্মুক্ত হয়েছে এক নতুন যুগ। অন্যদিকে নওয়াজ শরীফের সমর্থকরা এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে। এর আগে তারা এ মামলাকে ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছিল। গতকালও তাদের কণ্ঠে তারই প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। জুনিয়র একজন মন্ত্রী আবিদ শের আলী বলেছেন, যারা খুশি, আনন্দে নাচছে তারা আগামী দিনে কাঁদবে। তারা গণতন্ত্রের পশ্চাতে ছুরিকাঘাত করেছে। রেলওয়ে মন্ত্রী খাজা সাদ রফিকি টুইটে বলেছেন, এটা জবাবদিহিতা নয়। এটা প্রতিশোধ। এর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টার্গেট করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের এই অবস্থায় রাজনীতিতে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে তাতে অনুৎসাহিত হবেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।