নম্বর দেয়ার ক্ষেত্রে উদার ছিলেন না পরীক্ষকরা

Slider শিক্ষা

পাবলিক পরীক্ষায় ১০ বছরে পাস ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও এবার তাতে ছেদ পড়ছে। পরীক্ষার রেজাল্টে এমন ধাক্কায় হিসাব মেলাতে পারছেন না অনেকে। অবশ্য এর কারণ হিসেবে মডেল পদ্ধতিতে (বোর্ড থেকে সরবরাহ করা নমুনা উত্তরপত্র) খাতা দেখার কথা বলছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ বোর্ড চেয়ারম্যানরা। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে অন্য কারণ। অন্যান্য বছরের মতো এইচএসসি পরীক্ষার খাতায় উদারভাবে নম্বর দেননি পরীক্ষকরা। এজন্য পাসের হার, জিপিএ-৫ উভয়টি কমেছে।
এবারের পরীক্ষায় ১০টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার ৬৮ দশমিক ৯১ ভাগ। যা গত বছেরর তুলনায় কমেছে ৫ দশমিক ৭৯ ভাগ। আর জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৭ হাজার ৯৬৯ জন। গত বছরের তুলনায় এ সংখ্যা কমেছে ২০ হাজার ৩০৭ জন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছর ইংরেজি ১ম ও ২য় এবং বাংলা দ্বিতীয় পত্র এই তিনটি বিষয় ছাড়া ২৬টি বিষয়ে ৫০টি পত্রে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে পরীক্ষা হয়েছে। সৃজনশীল পদ্ধতিতে নেয়া প্রত্যেকটি পত্র মূল্যায়ণ হয়েছে মডেল পদ্ধতিতে। এবার সারা দেশে ফল খারাপের অন্যতম কারণ ইংরেজি। এ বিষয়ে খারাপ ফলের কারণে বিভিন্ন বোর্ডের শিক্ষার্থীদের ফল বিপর্যয় হয়েছে। বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক ভালো ফল করলেও ইংরেজি ঝড়ে রীতিমতো পর্যুদস্ত মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা। আর শিক্ষামন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী, এবার ফল খারাপ হওয়ার কারণ মডেল পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়ণ। আর বোর্ড কর্মকর্তারা দেখছেন অন্যভাবে। তাদের বক্তব্য, এবার ২৬টি পত্রের ৫০টি পত্রে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা হয়েছে। ব্যতিক্রম ছিল বাংলা ২য়, ইংরেজি ১ম ও ২য় পত্র। এই তিন পত্রে সৃজনশীন পদ্ধতিতে পরীক্ষা না হওয়ায় খাতা মূল্যায়ণ হয়েছে পুরানো পদ্ধতিতে। মডেল পদ্ধতির মূল্যায়ণ না হলে ইংরেজিতে কেন বিপর্যয়! এর কারণ ব্যাখ্যা করে বোর্ড কর্মকর্তারা বলছে, এবার শিক্ষকদের উদারভাবে খাতা দেখতে নিষেধ করা হয়েছিল। ইংরেজি খাতার ব্যাপারে পরীক্ষকরা সব সময় নমনীয় মনোভাব দেখান। কিন্তু এবার বোর্ডের কড়াকড়ির কারণে তারা সেটি পারেনি। এ ছাড়াও প্রধান পরীক্ষকদের ১২% খাতা দেখতে বাধ্য করা হয়েছে। এ কারণে ফল বিপর্যয় হয়েছে।
বিষয়টি স্বীকার করে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কায়সার আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, কুমিল্লা বোর্ডের ফল খারাপ হওয়ার অন্যতম কারণ ইংরেজিতে ফল খারাপ। এ বোর্ডে সব বিষয়ে পাসের হার ৮০% বেশি। কিন্তু ইংরেজিতে অন্যান্য বোর্ডের চেয়ে ৩৮% কম শিক্ষার্থী পাস করেছে। এ কারণে এ বোর্ডের পাসের হার কমেছে। তিনি বলেন, বোর্ডের খাতা মূল্যায়নে মডেল পদ্ধতির নতুন নির্দেশনা দেয়ার পর পরীক্ষক, প্রধান পরীক্ষকরা খাতা দেখার ব্যাপারে উদায় মনোভাব দেখাননি। প্রতি বছর ইংরেজি বিষয়ে খাতা মূল্যায়নে পরীক্ষকরা একটু সহনসীলতা দেখালেও এবার সেটি দেখাননি। এ কারণে ইংরেজিতে ফল বিপর্যয় হয়েছে।
প্রতি বছর বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষকদের খাতা মূল্যায়নের জন্য বিষয়ভিত্তিক ১৮-২৫ ধরনের নির্দেশনা দেয়া হয়। এসব নির্দেশনায় ২৮, ২৯, ৩০, ৩১ এবং ৩২ নম্বর ত্যাগ করে বাড়িয়ে দিতে অর্থাৎ ৩৩ নম্বর দেয়ার কথা বলা হয়। নির্দেশনা শেষে আবার স্টার চিহ্ন দিয়ে ৩২, ৩৯, ৪৯, ৫৯, ৬৯ ও ৭৯ নম্বরকে দয়া ও সতর্কভাবে পুনরায় পরীক্ষা করে উচ্চতর গ্রেড করতে বলা হলেও এবার সে ধরনের কোনো নির্দেশনা দেখা যায়নি।
এ ব্যাপারে আন্তঃ শিক্ষা বোর্ড ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার মানবজমিনকে বলেন, খাতা দেখার একটা শৃঙ্খলা আনার সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। এজন্য পরীক্ষকদের দেয়া অনেক নির্দেশনা বাতিল হয়েছে, নতুন করে যোগ হয়েছে।
এ ব্যাপারে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের চেয়ারম্যান জিয়াউল কবির দুলু মানবজমিনকে বলেন, বোর্ড থেকে অলিখিত এক ধরনের নির্দেশনা দেয়া হতো। এতে বলা হতো, পাসের হার বাড়াতে হবে। এজন্য পরীক্ষকরা মন খুলে নম্বর দিতো। এবার সেটি হয়নি বলে মনে হয়েছে। তিনি বলেন, খাতা আরো সঠিকভাবে মূল্যায়ণ হলে এই পাসের হার আরো ১০% কমে যাবে। আমাদের দাবি, পাসের হার নয়, ক্লাস রুমে সঠিক পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে।
পরীক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অন্যান্য বছরের মতো এবার নম্বর বাড়িয়ে দেয়া বা সহনসীলভাবে খাতা দেখার বা মৌখিক কোনো নির্দেশনা বোর্ড থেকে দেয়া হয়নি। এজন্য তারা স্বাধীনভাবে খাতা দেখতে পেরেছে। তাদের অভিযোগ, মনে যা আসতো তাই লেখতো শিক্ষার্থীরা। এই লেখা দিয়ে আবার জিপিএ-৫ পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এমনও দেখা গেছে, জিপিএ-৫ নিয়ে চারদিকে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। আমরাও বাধ্য ছিলাম নম্বর দিতে। কারণ নির্দিষ্ট শতাংশ পাস বা জিপিএ-৫ না দিলে বোর্ড ও প্রধান পরীক্ষকের কাছে জবাবদিহি করতে হতো। পাসের হার কম হওয়ায় পরের বছর বোর্ডের পরীক্ষকের তালিকা পড়েছে এমন নজিরও আছে। এবার সে ধরনের কোনো লিখিত বা মৌখিক নির্দেশনা ছিল না।
বোর্ড কর্মকর্তারা জানান, ১২% খাতা দেখার বিধান থাকলেও তা না দেখেই প্রধান পরীক্ষকরা বোর্ডে রিপোর্ট জমা দিতো। এবার সেটি পারেনি। কারণ পরীক্ষকরা দেখার পর কোন ১২% খাতা মূল্যায়ণ করেছে তা নির্দিষ্ট করে রিপোর্ট দিতে হয়েছে তাদের।
কুমিল্লা বোর্ডের একাধিক পরীক্ষকের সঙ্গে কথা বলে  জানা গেছে, প্রতি বছর বোর্ড থেকে ২৫-২৬ ধরনের লিখিত নির্দেশনা দেয়া হয়। এর বাইরে নম্বর বাড়িয়ে দেয়া এবং খাতা দেখার ক্ষেত্রে নমনীয় মনোভাব এ ধরনের কিছু মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হতো। এবার এ ধরনের কোনো মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়নি। বরং প্রধান পরীক্ষকরা খাতা কঠিনভাবে দেখার কথা বলেছেন। সেই নির্দেশনা মানতে গিয়ে ইংরেজিতে ফল বিপর্যয় হবে ভাবতে পারেননি। এবার ইংরেজিতে প্রশ্ন কঠিন হওয়ার পাশাপাশি আমরা সঠিক মূল্যায়ণ করেছি। এজন্য ফল খারাপ হয়েছে।
বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এজন্য বোর্ডগুলো অনেকাংশে দায়ী। কারণ পরীক্ষকদের মনিটরিং না করা। এবার ময়মনসিংহে একজন পরীক্ষক ৬০০ খাতা না দেখেই মনগড়া নম্বর বসিয়ে দেন। পরে বোর্ডের তদন্তে এটি প্রমাণিত হওয়ায় তাকে বোর্ডের সব কার্যক্রম থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। একই সঙ্গে তার এমপিও বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। কর্মকর্তারা আরো জানান, স্কুলে স্কুলে শিক্ষকদের মধ্যে একটা সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। তারা এমসিকিউ ৪০ নম্বর উত্তর দেয়ার ক্ষেত্রে এক স্কুলের শিক্ষক অন্য স্কুলের শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতেন। কোনো রুমে একজন ৪০টি সঠিক উত্তর দেয়া মানে সবার ৪০টি সঠিক উত্তর হয়ে যেত। এমন অবস্থায় দুই বছর থেকে এমসিকিউ পরীক্ষার শুরুতে নেয়া হচ্ছে। এতেও এ প্রবণতা না কমায় এমসিকিউ ৪০ থেকে ৩০ নম্বরে নিয়ে আসা হয়েছে। এটি আরো কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *