দেশের ৪৩টি ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে আড়াই লাখ মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আটকে আছে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে ভূমি বিরোধ নিরসনে জটিলতা দেখা দিয়েছে। একদিকে বিচারকসংকট এবং অন্যদিকে আপিল আদালত না থাকার কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, বিচারকের তুলনায় মামলার সংখ্যা অনেক বেশি। এখন বিচারকদের মাথাপিছু গড় মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি। আইনে রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের বিধান আছে। কিন্তু আপিল শোনার জন্য দেশে কোনো আদালত নেই। এ ছাড়া ভূমি জরিপসংক্রান্ত প্রচলিত আইনকানুন হালনাগাদ করার কাজও শেষ হয়নি। ফলে ভূমি জরিপসংক্রান্ত চূড়ান্ত প্রতিকার পাওয়ার আশা এখনো ক্ষীণ।
সম্প্রতি প্রকাশিত সুপ্রিম কোর্টের একটি প্রতিবেদনে দেশের ভূমি জরিপসংক্রান্ত আড়াই লাখ মামলা ব্যবস্থাপনার এই চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। গত বছরের ২৪-২৫ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টে এক রুদ্ধদ্বার আলোচনায় ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের ৪৩ জন বিচারক ভূমি জরিপ বিরোধ বিষয়ে মত দেন। ওই মতামতের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে ১৩টি সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ওই আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, চূড়ান্ত রায় না পাওয়ায় মামলাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা খাজনা দিতে পারছেন না। ভূমির মালিকানা বদল করতে পারেন না। এমনকি কেউ হুমকি দিলেও ইনজাংশন বা অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চাইতে আদালতে আরজি পেশ করতে সমস্যায় পড়েন। আবার খাজনা হালনাগাদ না থাকায় জমি কেনাবেচায় সমস্যা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এই সমস্যা নিরসনে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের একটি প্রস্তাব ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবে বর্তমানে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলাগুলো সংশ্লিষ্ট জেলার সহকারী জজ ও সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে নিষ্পত্তির বিধান আছে। ট্রাইব্যুনাল গঠনের আগে এসব বিরোধ সাধারণ আদালতেই নিষ্পত্তি হতো। ভূমি মন্ত্রণালয়ের জবাব এলে দ্রুত আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
আরেক প্রশ্নের জবাবে আইনসচিব বলেন, জেলায় জেলায় হাইকোর্টের বিচারকের ক্ষমতাসম্পন্ন আপিল ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার জটিলতা বিবেচনায় আছে। এটা একটা দুরূহ বিষয়। আর সহকারী ও সিনিয়র সহকারী সচিবদের দেওয়া রায় বা আদেশের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক নিয়মে জেলা জজরা আপিল শুনবেন। আলাদা আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের দরকার হবে না। এতে মামলা নিষ্পত্তির হার ৫০ গুণ বেড়ে যাবে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এবং ভূমি ও রেকর্ডসের পরিচালক ফায়েকুজ্জামানের কাছে এর অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। তবে তাঁরা বিদ্যমান ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়কে দিয়েছেন বলে ইঙ্গিত দেন।
ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়া-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে ফায়েকুজ্জামান বলেন, বিরোধগুলো জরিপের আঙ্গিকে না হয়ে দেওয়ানি আঙ্গিকে নিষ্পত্তি হওয়ার কারণে ট্রাইব্যুনাল গঠনের মূল্য লক্ষ্য ব্যাহত হচ্ছে। তিনি ইঙ্গিত দেন, জরিপ অধিদপ্তরের কর্মীরা প্রতিদিন আপত্তি পর্যায়ে ২৫টি ও আপিল পর্যায়ে ১৫টি বিরোধের নিষ্পত্তি করতে পারেন। এতে ৫ শতাংশের বেশি ভুল হয় না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম ১১ জুন প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই এ বিষয়ে উদ্যোগ নেন। এ রকম একটি বৈঠকে আইন ও ভূমিসচিব (বর্তমানে মন্ত্রিসভা সচিব) অংশ নিয়েছিলেন। এরপর কোনো অগ্রগতি হয়েছে বলে জানা নেই।
মাথাপিছু মামলা ৫ হাজার ৭৬৭
সুপ্রিম কোর্টের প্রতিবেদন অনুসারে, এখন মাথাপিছু মামলা ৫ হাজার ৭৬৭। সুপ্রিম কোর্ট মনে করেন, প্রতি দেড় হাজার মামলার বিপরীতে একজন বিচারক নিয়োগ করা উচিত। এই ঘাটতির কারণে ট্রাইব্যুনাল যথাযথ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন না। ২৯ জেলার ট্রাইব্যুনালে পর্যাপ্তসংখ্যক লোকবল নেই। সেরেস্তাদারের পদই তৈরি করা হয়নি।
বর্তমানে আড়াই লাখ মামলা বিচারাধীন হিসেবে দেখানো হলেও এর অন্তত অর্ধেক মামলা শুধু বাদীদের দ্বারা ‘দায়ের’ করা অবস্থায় আছে। কারণ, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে সমন জারি ছাড়া কোনো মামলার শুনানি করা যায় না। প্রতিটি ট্রাইব্যুনালে মাত্র একজন প্রসেস সার্ভার। একটি দরখাস্ত থেকে কয়েক ডজন লোককে সমন দেওয়ার দরকার পড়ে। ময়মনসিংহে একজন বিচারকের কাঁধে ৩৩ হাজার মামলা। সেখানে এর অর্ধেক মামলায়ও কারও বিরুদ্ধে সমন জারি করা সম্ভব হয়নি।
ট্রাইব্যুনালের আড়াই লাখ ছাড়াও সারা দেশে এ মুহূর্তে কর্মরত ৩৫৬ জন সহকারী ও জ্যেষ্ঠ সহকারী বিচারকের আদালতে ভূমিসংক্রান্ত প্রায় ছয় লাখ মামলা বিচারাধীন।
মোট ৪৭১টি বিচারকের পদের মধ্যে ১১৯টি শূন্য। প্রধান বিচারপতি মামলাজট কমাতে ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারী ও জ্যেষ্ঠ বিচারকের সংখ্যা দ্বিগুণ করার পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছেন। আইন কমিশন ২০১২ সালে তিন হাজার অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল। তবে এ ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি নেই।
১৩ বছরেও আপিল ট্রাইব্যুনাল হয়নি
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের ৩০ লাখ বিচারাধীন ফৌজদারি মোকদ্দমার সিংহভাগ ভূমি বিরোধসংক্রান্ত হলেও গত ১৩ বছরে কোনো আপিল ট্রাইব্যুনাল করা হয়নি। অথচ আইন বলছে, ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে তিন মাসের মধ্যে আপিল করা যাবে। বিচারকেরা বলছেন, এভাবে আপিল না হওয়ার কারণে দুটি সমস্যা তৈরি হচ্ছে। প্রথমত, রায় কার্যকর করা যাচ্ছে না বলে এর তেমন মূল্য থাকছে না। দ্বিতীয়ত, রায়ে ক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা বিত্তশালী, তাঁরা রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করার আরজি নিয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করতে পারছেন। অবশ্য রিটের মাধ্যমে আবেদনকারীরা চূড়ান্ত প্রতিকার পেতে পারেন না। কিন্তু গরিবেরা সে সুযোগও পান না।
জরিপ মোকদ্দমায় সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষের মৃত্যু হলে কী হবে, বিদ্যমান আইনে তা বলা নেই। ট্রাইব্যুনাল ওই মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করতে বা মৃত ব্যক্তির নাম বাদ দিতে পারেন না। এটা মামলাজট তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে কোনো মোকদ্দমায় প্রয়োজনীয় নতুন পক্ষ যুক্ত করতেও ট্রাইব্যুনাল অপারগ।
সুপ্রিম কোর্টের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রায়ই অভিযোগ করা হয় যে সরদার আমীন ও রাজস্ব কর্মকর্তারা অবৈধ সুবিধার বিনিময়ে সম্পূর্ণ মিথ্যা বর্ণনার মাধ্যমে রেকর্ড অব রাইটস প্রস্তুত করে থাকেন। প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও এভাবে তাঁদের চাহিদা পূরণ করেন। ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন বা তদন্ত ছাড়া কোনোভাবেই পক্ষগুলোর অভিযোগের সত্য-মিথ্যা নির্ণয় করা অসম্ভব। অথচ এটা যাচাইয়ে কমিশনার নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।
ভিন্নমত ও ভুক্তভোগীর প্রতিক্রিয়া: আড়াই লাখের মধ্যে ৪৪ হাজার ৩৯০টি মামলা নিয়ে কিশোরগঞ্জ শীর্ষে রয়েছে। এই জেলার চার দশকের অভিজ্ঞ দেওয়ানি আইনজীবী ভূপেন্দ্র চন্দ্র ভৌমিক। তাঁর চেম্বারে এক হাজারের বেশি মক্কেল আছেন। তিনি বলেন, মামলা দায়েরে এ জেলায় দুই বছর সময় দেওয়া হয়েছিল। এরপর আর নতুন মামলা নেওয়া হচ্ছে না। তাঁর এক হাজার মক্কেলের মধ্যে বড়জোর ৩০ জন রায় পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছেন। কিন্তু এসব মামলার সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপিল করতে পারছে না। তিনি আইন মন্ত্রণালয়ের ওই আইন সংশোধনের প্রস্তাবের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করেন। তাঁর যুক্তি, কিশোরগঞ্জের ১৩টি সহকারী ও জ্যেষ্ঠ সহকারী আদালত মামলার ভারে ন্যুব্জ। তাঁদের ওপর এটা চাপালে তেমন কোনো গতি আসবে না। তিনি মামলার সংখ্যার অনুপাতে সারা দেশে বেশি ট্রাইব্যুনাল এবং আপিল শুনতে হাইকোর্ট বিভাগের ১০ বিচারপতির নেতৃত্বে ১০টি একক বেঞ্চ গঠনের সুপারিশ করেন।
জানা গেছে, আইন ও বিচার বিভাগ ২০১২ সালের ২৬ জুলাই হাইকোর্টের কোনো কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের নেতৃত্বে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রেখে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল। এতে গাড়ি ও সহায়ক লোকবলের উল্লেখ থাকলেও পরে এর কোনো কিছুই বাস্তবে দেখা যায়নি। ২০১৩ সালের ৩ জানুয়ারি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মারযি-উল হককে আপিল জজ হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হয়। কিন্তু এর অল্প পরে তিনি মারা যান। এরপর আর কোনো প্রস্তাব সুপ্রিম কোর্টে যায়নি। একই বছরের ২৮ জানুয়ারি আইন ও বিচার বিভাগ ভূমি মন্ত্রণালয়কে দেওয়া এক চিঠিতে আপিল আদালতের জন্য এজলাস ও লোকবল দিতে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু এ বিষয়ে তাদের সাড়া মেলেনি বলে আইন মন্ত্রণালয় সূত্রের দাবি।
উল্লেখ্য, ভূমি জরিপকেই ভূমির মালিকানা নির্ধারণী হিসেবে দেখা হয়। ১৯৫০ সালের স্টেট অ্যান্ড টেনান্সি (স্যাট) অ্যাক্ট মতে, প্রতি ৩০ বছর অন্তর ভূমি জরিপ হালনাগাদ করার বিধান আছে। দেশের ইতিহাসের প্রথম ভূমি জরিপ ১৯৮৫ সালে শুরু হলেও তা এখনো শেষ হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই আড়াই লাখ মামলার সঙ্গে দেশের প্রস্তাবিত ডিজিটাল ভূমি জরিপ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করারও ভাগ্য জড়িয়ে আছে