ইউরোপ থেকে অবৈধ বাংলাদেশিদের দ্রুত ফেরত পাঠাতে এবার ভিসাকে হাতিয়ার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। প্রায় দেড় বছর ধরে নানাভাবে সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ায় ইইউ এই পথে যাওয়ার কথা বলছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ভিসার ওপর কড়াকড়ির বিষয়টিকে বিশেষভাবে বিবেচনায় নিয়ে আগামী সেপ্টেম্বরে ইইউর সঙ্গে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) বা মানসম্মত পরিচালনা পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকায় ইইউ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে গতকাল বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানা গেছে।
তবে দুই পক্ষের কাছ থেকে অবৈধ বাংলাদেশিদের সংখ্যা নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণা মেলেনি। ইইউ বলছে, এই সংখ্যা ৮০ হাজার। জবাবে বাংলাদেশ বলছে, এটা অনুমাননির্ভর সংখ্যা। এর আগে ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান দপ্তর ইউরোস্টেটের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছিল, ২০০৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৯৩ হাজার ৪৩৫ জন বাংলাদেশি ইউরোপের দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে।
ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পৌঁছেছেন ৮ হাজার ৪৩৬ জন বাংলাদেশি। আর ২০১৬ সালে গিয়েছিলেন ৮ হাজার ১৩১ জন। ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১। ইতালির কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশকে জানিয়েছে, দেশটির উপকূলে আটক এসব লোক লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইতালিতে গেছেন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছর ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপ পাড়ি জমানো লোকজনের শীর্ষে আছেন বাংলাদেশের নাগরিকেরা।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ‘ডেসপারেট জার্নিজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছানো শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় আছে বাংলাদেশ। ওই বছর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া ৮ হাজার ১৩১ জন বাংলাদেশির মধ্যে শিশুর সংখ্যা ছিল ৭২।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৭ হাজার ২১৫ জন বাংলাদেশি রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন। এদের মধ্যে ১১ হাজার ৭১৫ জনের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত ইউরোপে অবৈধ হওয়ার পর দেশে ফিরতে সাড়ে ৪ হাজার বাংলাদেশিকে দেশে ফেরার অনুমতিপত্র দেওয়া হয়। এদের মধ্যে ৩ হাজার ৩০০ অনুমতিপত্র দেওয়া হয়েছে যুক্তরাজ্য থেকেই।
দেড় বছর ধরে সুনির্দিষ্ট কোনো সংখ্যার উল্লেখ না করলেও বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক লোকজনের ইউরোপে অবস্থানের কথা বলছে ২৮ দেশের এই ইউরোপীয় জোট। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার মতে, কয়েক বছর ধরে সিরিয়ার শরণার্থী সংকটকে পুঁজি করে মানব পাচারকারীরা ডিঙিতে করে ভূমধ্যসাগর দিয়ে বিভিন্ন দেশের লোকজনকে ইউরোপে পাচার করছে। ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে পাচার হওয়া লোকজনের মধ্যে বাংলাদেশের নাগরিকদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে ইউরোপ।
তবে গত পাঁচ বছরে ব্রাসেলসে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বাংলাদেশের কয়েকজন কূটনীতিকের সঙ্গে আলাপ করে ধারণা পাওয়া যায়, সিরিয়ার শরণার্থী সংকটের আগেও অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরানোর কথা বলে আসছে ইইউ। বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ইইউতে যুক্ত হওয়ার পর থেকেই সদস্যদেশগুলোর লোকজনের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে জোটের ওপর রাজনৈতিক চাপ আছে। ফলে বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসীদের ফেরানোর কথা ইউরোপ আগে থেকেই বলছে।
অবৈধ লোকজনকে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে গত জুনে বাংলাদেশের কাছে এসওপির একটি খসড়া দিয়েছিল ইইউ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনার পর এ বছরের জুনে দেশের অবস্থান চূড়ান্ত করে খসড়ার ব্যাপারে ১২ জুলাই ব্রাসেলসে যৌথ কমিশনের বৈঠকে বাংলাদেশের মতামত তুলে ধরে। এ নিয়ে মতপার্থক্য থাকায় শেষ পর্যন্ত রীতি অনুযায়ী যৌথ বিবৃতি প্রচার হয়নি। কমিশনের বৈঠকের এক দিন পর প্রচারিত বিজ্ঞপ্তিতে ইইউ জানায়, অবৈধ বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে নিতে এসওপি চূড়ান্ত করার আলোচনা জুলাইয়ের মধ্যে শেষ করতে বাংলাদেশের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে ইইউ। এরপর ইইউ নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করে সংশোধিত এসওপি পাঠায় বাংলাদেশের কাছে। এই পরিস্থিতিতে ২৫ জুলাই অবৈধ বাংলাদেশিদের ইউরোপ থেকে ফেরানোর বিষয়ে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের পর ইউরোপের বহিঃসম্পর্ক বিভাগের উপমহাসচিব ক্রিশ্চিয়ান লেফলারকে দ্রুত ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি পাঠান পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক।
অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান নিয়ে অসন্তোষ জানিয়ে আসছে ইইউ। জানতে চাইলে ঢাকায় ইইউ রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদু গতকাল দুপুরে তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রাসেলসে যৌথ কমিশনের বৈঠকে বাংলাদেশ এসওপির ব্যাপারে যে পাল্টা প্রস্তাব দিয়েছে, সেটিকে ইতিবাচক মনে করি। কারণ, বিষয়টি নিয়ে গত বছরের এপ্রিল থেকে কথা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘দুই সপ্তাহ ধরে এ বিষয়ে যে অগ্রগতি হয়েছে, তাতে বিষয়টি সুরাহার জন্য আমাদের আর এক বছর লাগবে না। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এটি চূড়ান্ত হবে বলে আশা রাখি।’
এ নিয়ে আলোচনার জন্য ব্রাসেলস থেকে ইইউর কোনো জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আগস্টে ঢাকায় আসছেন কি না—জানতে চাইলে ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেন, পরের দফা আলোচনা নিশ্চিতভাবেই ঢাকায় হবে। ব্রাসেলসের যে প্রতিনিধিদলের ঢাকায় আসার কথা রয়েছে, তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকবে।
ইউরোপে কত অবৈধ বাংলাদেশি এখন আছেন—এই প্রশ্নের উত্তরে পিয়েরে মায়াদু বলেন, ‘খোলামেলাভাবে বললে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা নেই। তবে ইতালিতে অবৈধ বাংলাদেশিদের যে সংখ্যা দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উল্লেখ করেছে, সেটি যথেষ্ট উদ্বেগের। কারণ, ২০১৬ সালে যে সংখ্যায় বাংলাদেশের লোকজন অবৈধভাবে গেছে, এ বছরের প্রথম ছয় মাসেই সংখ্যাটি তার চেয়ে অনেক বেশি। আর লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে লোকজন ইতালিতেই যাচ্ছেন; পর্তুগাল কিংবা ডেনমার্কে নয়। কাজেই ইতালির সংখ্যাকেই আমাদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত।’
ইউরোপ থেকে অবৈধ অভিবাসীদের ফেরাতে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে মো. শহীদুল হক গতকাল বিকেলে তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে একটি নিয়মতান্ত্রিক ও সুশৃঙ্খল অভিবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব করেছে। বৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়া সুরক্ষায় বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। কাজেই ইউরোপে অনিয়মিত হয়ে পড়া বাংলাদেশের লোকজনকে ফেরানোর প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার ব্যাপারে খুব শিগগির ইইউর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হবে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই আলোচনা হতে পারে।