পানির নিচে এশিয়া। বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের প্রায় ১৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষের জীবন ঝুঁকিতে। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে এই ঝুঁকি অনেক বেশি। সারাবিশ্বে ১৯৫০ সালের পর বন্যার কারণে যত মানুষ মারা গেছেন বা আহত হয়েছেন তার বেশির ভাগই ঘটেছে এশিয়ার এ তিনটি দেশে। বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি ক্যাথোলিক ডি লোবেনস-এর ইমার্জেন্সি ইভেন্টস ডাটাবেজ অনুসারে ১৯৫০ সালের পর এ তিনটি দেশে বন্যায় মারা গেছে কমপক্ষে ২২ লাখ মানুষ। এর মধ্যে চীনেই ১৯৫৯ সালের বিপর্যয়কর বন্যায় মারা গেছে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। অনলাইন সিএনএন এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে। ‘এশিয়া আন্ডার ওয়াটার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশ সহ এশিয়ার মানুষের ভয়াবহ সব দুর্ভোগের কথা। এতে বাংলাদেশের কুতুপালংয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেয়া মিয়ানমারের খোরশেদা খাতুনের দুর্দশা ফুটে ওঠে। সিএনএনের সাংবাদিক বেন ওয়েস্টকট ও স্টিভ জর্জ এ নিয়ে প্রতিবেদন লিখেছেন। খোরশেদা খাতুন বলেছেন, তার এখন কিছুই নেই। সব ধুয়ে নিয়েছে পানি। মিয়ানমার থেকে জানুয়ারিতে তিনি দু’কন্যাকে নিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। কিন্তু এর ৫ মাস পরে ঘূর্ণিঝড় মোরা তার সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। এসব কথা তিনি জুন মাসে বলেছেন ইউনিসেফের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এর কয়েক সপ্তাহ পরে দক্ষিণ চীনের হিমালয়জুড়ে বন্যার কারণে ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয় এক কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ। এ বছর দক্ষিণ-পূর্ব চীনের শুধু জিয়াংসি প্রদেশে এখন পর্যন্ত ৪৩ কোটি ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। পার্শ্ববর্তী হুনান প্রদেশে ৫৩ হাজার বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্রমাগত বিরূপ আবহাওয়ার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কয়েক শ’ কোটি মানুষ প্রচণ্ড ঝুঁকিতে রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশনের জলবায়ু বিষয়ক বিজ্ঞানী ডেউই কিরোনো বলেছেন, আগামী ৩০ বছরে আরো ভারি বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পাবে এশিয়ায়। দক্ষিণ এশিয়া এরই মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে জলমগ্ন অঞ্চলগুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছে। গড়ে প্রতি বছর এখানে ১০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এক্ষেত্রে গ্রাম থেকে শহরমুখী লাখ লাখ মানুষের আবাসন নিশ্চিত করতে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে শহর এলাকা। তবে ড্রেনেজ ব্যবস্থা নাজুক। পরিকল্পনায় রয়েছে ঘাটতি। অদূরদর্শিতা। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং ফেলো ও ডব্লিউডব্লিউএফ উপদেষ্টা পল সায়েরস বলেছেন, যথাযথ ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। যা ছিল ফসলি জমি, সবুজ ক্ষেত তা এখন পরিণত হয়েছে শহরে। এরই মধ্যে ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) তাদের সর্বশেষ রিপোর্টে বলেছে, জলবায়ু ও আবহাওয়া সংক্রান্ত বিপর্যয়ে এরই মধ্যে বিরাট অঙ্কের অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হয়েছে এশিয়া। বিশ্বে মোট অর্থনৈতিক ক্ষতির এক চতুর্থাংশ এই এশিয়াতেই ঘটেছে। এই জুলাই মাসে মধ্য চীনে বন্যা হয়েছে। এরই মধ্যে কমপক্ষে ৯০ জন মারা গেছেন না হয় নিখোঁজ হয়েছেন। হুনান প্রদেশের শিলং গ্রামে বসবাস করেন এমন একজন বলেন, রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে আছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাট রয়েছে। পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। ফোনে কোনো সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছে না। বয়স্ক ও শিশুরা খাদ্যের অপেক্ষায় আছে। দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। সর্বত্র কাদা আর কাদা। বড় শহরগুলো যেন মৃত্যুপুরী। গত এক দশকে প্রতি বছর বাংলাদেশ, ভারত ও চীনে বন্যায় কমপক্ষে ১০০০ মানুষ মারা যান। কোটি কোটি ডলারের ক্ষতি হয়। এ অঞ্চলে বড় তিনটি নদী হলো গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও ইয়াংজি। এর ফলেই দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় বন্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশ ও ভারতে প্রায় ৫০ কোটি অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫০ ভাগ বসবাস করেন এ তিনটি নদীর অববাহিকায়। চীনে এ সংখ্যা ৩০ কোটি, যা সেখানকার মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ। সব মিলে এ তিনটি নদীর অববাহিকায় বা একে কেন্দ্র করে এর আশেপাশে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৪ ভাগ বসবাস করে। শুধু চীনের কথাই ধরা যাক। সেখানে বিশাল ইয়ংজির অববাহিকা বা এর আশেপাশের মাটি ভীষণ উর্বর। নদী থেকে সুবিধা নেয়াও খুব সহজ। ফলে চীনের যে জাতীয় প্রবৃদ্ধি তার শতকরা ৪০ ভাগের সরবরাহ আসে একে কেন্দ্র করে। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক ২০১২ সালে তাদের এক রিপোর্টে বলেছে, এশিয়ার অনেক শহর, বিশেষ করে মেগাসিটিগুলো গড়ে উঠেছে বড় বড় নদীগুলোর অববাহিকায়। সেখানে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে শহরগুলোকে যুক্ত করতে তৈরি করা হয়েছে বন্দর। যখনই ভারি বর্ষণ হয় তখন সেই পানি এসব নদীতে গিয়ে পড়ে। এ জন্য দ্রুতগতিতে পানির স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। ভাসিয়ে নেয় শহর, বন্দর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এ বছর বৃষ্টিপাতের ফলে ইয়াংজি নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। সতর্কীকরণ লেভেলের ৩.২ মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তা। এর ফলে দু’কূল প্লাবিত হয়েছে। ফসল ও ঘরবাড়ি ভেসে গেছে। পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ট্রান্সপোর্ট, আরবান অ্যান্ড ডিজঅ্যাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিষয়ক বিশ্বব্যাংকের সেক্টর ম্যানেজার আভাস ঝা বলেছেন, ব্যাপক অপরিকল্পিত উপায়ে করা হচ্ছে শহরায়ন। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে হয়তো তাদের সামনে বড় কোনো ঝুঁকি দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে টেকসই ড্রেনেজ ব্যবস্থায় যথেষ্ট বিনিয়োগ করা হচ্ছে না। ১৯৭৬ সালে চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুং যখন মারা যান তখন বড় শহরগুলোতে মাত্র শতকরা ১৭ ভাগ মানুষ বসবাস করতো। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ২০১৬ সালের একটি রিপোর্ট অনুসারে এ সংখ্যা এখন শতকরা ৫৬ ভাগের ওপরে। ভারতও প্রায় চীনের মতো একই অবস্থা থেকে যাত্রা শুরু করেছে। সেখানেও শহরে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। বড় শহরগুলোতে বসবাস করছে শতকরা ৩৩ ভাগ মানুষ। আভাস ঝা বলেন, শহরকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত নেয়ায় মানুষ শুধু দৃঢ় অবকাঠামো নির্মাণের দিকেই বিনিয়োগ করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু এক্ষেত্রে ড্রেনেজ ব্যবস্থা বন্যার ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হতে পারে। সবুজ মাঠের ভেতর বা জলাভূমির ভেতর দিয়ে পানি চলাচলের যে প্রাকৃতিক ড্রেনেজ (খাল বা নদী) তা ভরাট করা হয়েছে। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে আকাশচুম্বী ভবন। এক্ষেত্রে কৃত্রিম কোনো বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হয় নি। ফলে ভারি বৃষ্টিপাত হলেই সেই পানি সরার কোনো পথ নেই। ওদিকে বৃষ্টির প্রকোপ তো বাড়ছেই। আভাস ঝা বলেন, আপনি যদি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে প্রমাণ পেতে চান তাহলে ৫ বছর পেছনে গিয়ে এশিয়ার দিকে তাকাতে হবে। মুম্বই, সাংহাই, হ্যানয়, বেইজিং, নমপেনসহ এশিয়ার প্রতিটি বড় শহরে বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, পরিস্থিতি এর চেয়ে আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। সিএসআইআরও-এর বিশেষজ্ঞ কিরোনো বলেন, তাপমাত্রা বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। ফলে ভারি বর্ষণের আশঙ্কাও বাড়ছে। প্রতি বছর বৃষ্টির পরিমাণ বাড়ার কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পরিষ্কার হবে। তাতে আরো ভয়াবহ বৃষ্টি হতে পারে। একদিনেই যদি অনেক ভারি বৃষ্টি পড়ে তাহলে একদিনে বা এক ঘণ্টায় অনেক স্থানে বন্যা হওয়ার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। ভবিষ্যতে যদি দক্ষিণ এশিয়াকে এমন ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে হয় তাহলে স্থানীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে অনেক বিষয়ে পরিবর্তন আনতে হবে। আভাস ঝা-এর মতে এক্ষেত্রে বড় শহরগুলোর সামনে দুটি পথ খোলা আছে। তা হলো শহর থেকে পানি সরিয়ে নেয়ার মতো অবকাঠামো এবং পানি থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেয়ার জন্য প্রতিরোধযোগ্য ব্যবস্থা। তার ভাষায়, এক্ষেত্রে আগেভাগে সতর্ক ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। গড়ে তুলতে হবে সবুজবেষ্টিত অবকাঠামো। এক্ষেত্রে যতটা সম্ভব বিনিয়োগ করতে হবে। আগেভাগে সতর্কতামূলক পদক্ষেপে এক ডলার খরচ করা হলে পরে চার থেকে আট ডলারের ক্ষতি এড়ানো যাবে। তবে এ কাজটি খুব সহজ নয়। ২০১০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের সড়ক, রেল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হলে ২৬০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ প্রয়োজন হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্থানীয়ভাবে পরিবর্তন আনতে অনেক বেশি খরচের প্রয়োজন হবে না। বাংলাদেশ, ভারত ও চীনে যেসব শহর আছে তার মধ্যে গৃহায়নের ক্ষেত্রে উত্তম স্থান নির্বাচন করার ক্ষেত্রে সমন্বয় থাকা উচিত। সেখানে যাতে বন্যা না হয় সে ব্যবস্থা নেয়া উচিত সহযোগিতার মাধ্যমে।