গত রোববার সকালে চট্টগ্রামে এসেই এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হলো। বাসে করে পতেঙ্গা থেকে আগ্রাবাদ পর্যন্ত এসেই শুরু হলো বিপত্তি। বাস ঠায় দুই ঘণ্টা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। সামনে তাকাতেই চোখে পড়ল সড়কজুড়ে থইথই পানি। বাসের একজন কর্মচারী বললেন, ‘আরও ঘণ্টাখানেক লাগবে এই এলাকা পার হতে। আপনি এখানে নেমে পড়েন। এখন জোয়ার চলছে। ভাটা লাগলে তারপর যেখানে যাবেন, সেখানে রওনা হইয়েন।’ বাস কর্মচারীর মুখে জাহাজের সারেংয়ের মতো পরামর্শ শুনে কিছুটা তাজ্জব হতে হলো।
আর অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য না থাকায় বাস থেকে নামতেই পড়লাম কোমরপানিতে। মাথায় বাক্সপ্যাটরা আর কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ নিয়ে প্রায় সাঁতরে ফুটপাতে ওঠা গেল। এক রেস্তোরাঁয় নাশতা খাওয়ার অছিলায় ঘণ্টাখানেক আশ্রয় নেওয়ার সময় চোখ আটকে গেল একটি স্থানীয় দৈনিকের পাতায়। একটি ছোট্ট বক্স নিউজ। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত এই শহরের কোথায়, কখন জোয়ার-ভাটা হবে, তার পূর্বাভাস ও সময়সূচি নিয়ে এই সংবাদ।
রবি থেকে মঙ্গল—এই তিন দিনে চট্টগ্রাম শহরে আমাকে চলাফেরা করতে হয়েছে জোয়ার-ভাটার সময় হিসাব করেই। শহরের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ-এক্সেস রোড, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ বা অভিজাত আবাসিক এলাকা সিডিএ, হালিশহর, চান্দগাঁও আর প্রান্তীয় এলাকা পাথরঘাটা, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, বাঁকখালি ও কাপাসগোলায় কর্ণফুলী নদীর পানি জোয়ারের সঙ্গে উঠে পড়ছে। আবার ভাটায় নেমে পড়ছে। চট্টগ্রামবাসীর একটি বড় অংশের মানুষের কারও সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া বা কোনো কাজে বের হওয়া এখন জোয়ার-ভাটার সময়ক্ষণকে আমলে নিয়েই করতে হচ্ছে।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে আগ্রাবাদ থেকে দুই কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম বন্দরে যেতে লেগে গেল দুই ঘণ্টা। সেখানে কাজ সেরে হালিশহরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই শোনা গেল, সেখানে জোয়ার শুরু হয়েছে। পানি কোমর পেরিয়ে গলা পর্যন্ত উঠেছে। প্রাইভেট কার বা সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা রিকশাচালক কেউই ওই এলাকায় যাচ্ছেন না। কেননা, রাস্তার মধ্যেই পানি ৫ থেকে সাড়ে ৫ ফুট পর্যন্ত উঠে গেছে। বেশির ভাগ অফিসের নিচের তলা ডুবে গেছে। ভাটায় যখন পানি কিছুটা কমল, তখন বিকেল পাঁচটা পেরিয়ে গেছে।
আগ্রাবাদ কমার্স কলেজের পাশের এলাকায় জোয়ারের কোমরপানির বিপদের সঙ্গে নতুন আপদ চোখে পড়ল। বাণিজ্যিক ভবনগুলো বাদে সেখানকার বেশির ভাগ ভবনের বিদ্যুৎ-সংযোগ বন্ধ করে দিচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। দুর্ঘটনার আশঙ্কায় যতক্ষণ জোয়ার থাকে, ততক্ষণ সেখানে বিদ্যুৎও থাকে না।
আগ্রাবাদ কমার্স কলেজের পাশে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল ঘুটঘুটে অন্ধকার। টর্চলাইট ও মোমবাতি জ্বালিয়ে সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিস করছেন। সকাল থেকে বাড়ির সামনে কোমরপানি, এই কারণে অনেকে অফিসে আসতে পারেননি। যাঁরা এসেছেন তাঁরা আগ্রাবাদ মোড় থেকে দুই কিলোমিটার পথ কোমরপানি ডিঙিয়ে সেখানে এসেছেন।
কথা হয় জেলা শিক্ষা অফিসের কর্মচারী নাসিমা বেগমের সঙ্গে। জানালেন, প্রতিদিন অফিসে আসার সময় সঙ্গে এক সেট কাপড় নিয়ে আসেন। অফিসে তা বদলে সারা দিন অফিস করে যখন বাসায় ফেরেন, তখন ওই কাপড়ও নোংরা পানিতে ভিজে যায়। প্রতিবছর জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত এভাবে তাঁদের অফিস করতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, চার-পাঁচ বছর আগেও এখানে জোয়ারের পানিতে বড়জোর পায়ের পাতা ভিজত। ধীরে ধীরে তা হাঁটু ডিঙিয়ে কোমর পর্যন্ত উঠেছে। গতকাল ও পরশু কমার্স কলেজ এলাকায় গলা পর্যন্ত পানি উঠেছে।
আগ্রাবাদ এলাকায় প্রতিবছর পানির উচ্চতা বাড়তে থাকার এই স্থানীয় অভিজ্ঞতার প্রমাণ অবশ্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কাছেও পাওয়া গেল। তারা বলছে, শুধু পানির উচ্চতা না, শহরের মধ্যে জোয়ারের পানির বিস্তৃতিও বাড়ছে। পাউবোর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত এক যুগে কর্ণফুলী নদীর পানির উচ্চতা সর্বোচ্চ আধা মিটার পর্যন্ত বেড়েছে। এবার কাপ্তাই লেকের পানি ছেড়ে দেওয়া আর টানা বৃষ্টির পানি জোয়ারের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। ফলে পানির উচ্চতা বেড়েছে।
পাউবোর পর্যবেক্ষণে চট্টগ্রাম শহর থেকে জোয়ারের পানি নেমে যাওয়ার সময়কালও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরে দিনে-রাতে মিলিয়ে দুবার জোয়ার-ভাটা হয়। গড়ে একেকটি জোয়ারের পানি প্রাকৃতিক নিয়মে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টায় শহরে ওঠে আর বাকি পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টায় ভাটা বা পানি নেমে যায়। কিন্তু জোয়ারের প্রাকৃতিক নিয়ম বদলে দিচ্ছে শহরের যত সব কৃত্রিম বাঁধা বা অবকাঠামো। জোয়ারের পানি শহর থেকে নামতে সময় লাগছে আট থেকে নয় ঘণ্টা। ওই সময়ে বৃষ্টিপাত না হলেও শহরের বড় অংশ জলাবদ্ধ থাকছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের (চট্টগ্রাম) প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম শামসুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, আগে শহরের আগ্রাবাদ ও চাক্তাই এলাকায় জোয়ারের পানি প্রবেশ করত। এখন আরও ৮ থেকে ১০টি এলাকায় জোয়ারের পানি ঢুকছে। জোয়ারের উচ্চতা গত এক যুগে অর্ধমিটার বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এবার জলাবদ্ধতার সঙ্গে অতিবৃষ্টি ও কাপ্তাই লেকের ছেড়ে দেওয়া পানি যোগ হয়েছে। ফলে গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধতা ও দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে।
চট্টগ্রাম আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, গত তিন দিনে চট্টগ্রামে ৪১৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আর চট্টগ্রাম বন্দরের হিসাবে গত তিন দিনে কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে জোয়ারের পানির উচ্চতা সাড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৬ মিটার পর্যন্ত উঠেছিল, যা এই সময়ে ৩ থেকে ৪ মিটার উঁচু হয়ে থাকে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের সঙ্গে প্রকৃতির পরিবর্তন যোগ হয়ে শহরে জলাবদ্ধতা বাড়ছে বলে জানান আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ শেখ হারুন উর রশিদ।