উত্তম কুমারের মহানায়ক হয়ে ওঠার গল্প: ৩৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

Slider বিচিত্র বিনোদন ও মিডিয়া

8d148ad4ba73f0047ec45b1f925e437e-5975d40e6b5f5পর পর তিনটি ছবি ফ্লপ। তবুও ছেলেটি স্টুডিওপাড়ায় একটা রোলের জন্য ঘুরে বেড়ায়। ছেলেটিকে দেখলে সবাই রংতামাশা করে। ফ্লপ মাস্টার জেনারেল বলে হাসাহাসি করে। ছেলেটির চোয়াল ক্রমশ শক্ত হতে থাকে। মনে মনে আরও কঠিন প্রতিজ্ঞা করে সে। কিন্তু করলেই তো হবে না। সুযোগ পেতে হবে। কিন্তু কে দেবে সুযোগ?

কেউ না জানলেও একজন জানতেন, এই ছেলেটি পারবে। তিনি হলেন পাহাড়ী স্যান্যাল। প্রায় দিন তিনি ছেলেটিকে লক্ষ করেন। কিন্তু কোনো কথা বলেন না। ঠিক এমন সময় নির্মল দে তাঁর নতুন ছবি ‘বসু পরিবার’ করার জন্য নায়ক হিসেবে ঠিক করলেন কালী ব্যানার্জিকে। কালী ব্যানার্জি তখন বিখ্যাত নায়ক। কিন্তু নির্মল দে কালী ব্যানার্জির ডেট পেলেন না। নিজের ঘরে বসে ভাবছেন, এখন তাহলে কী করা! এমন সময়ে ঘরে এলেন পাহাড়ী স্যান্যাল। পাহাড়ী স্যান্যালকে সব খুলে বললেন। পাহাড়ী স্যান্যাল অল্প হেসে বললেন, ‘দূর, এত চিন্তা করছ কেন? হাতের কাছেই নায়ক রয়েছে।’
নির্মল দে লাফিয়ে উঠলেন,‘কে?’ তারপর নায়কের নাম শুনে ধপ করে বসে পড়লেন। বললেন, ‘পাহাড়ীদা আপনি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন? ওকে নিলে হলে ঢিল পড়বে, কে সামলাবে বলুন?’
পাহাড়ী স্যান্যাল বললেন, ‘নামটা পাল্টে দাও, কেউ জানতে পারবে না। আমি কথা দিচ্ছি, ওকে নিয়ে ঠকবে না। এখন ও ইস্পাতের মতো কঠিন হয়ে উঠেছে। শুধু অস্ত্র তৈরি করার অপেক্ষা।’
নির্মল দে কি মনে করে, সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটিকে ডেকে পাঠালেন। পাহাড়ী স্যান্যাল বললেন, ‘বাপু, বাপের দেওয়া নামের মায়া কি ছাড়তে পারবে? তাহলে একটা সুযোগ আছে।’
ছেলেটি আস্তে আস্তে মাথা নাড়াল। পাহাড়ী স্যান্যাল বললেন, ‘অন্য নাম আছে তোমার?’
ছেলেটি একটু থেমে বলল, ‘দাদু আমাকে উত্তম বলে ডাকতেন।’
লাফিয়ে উঠলেন পাহাড়ী স্যান্যাল। বললেন, ‘নির্মল, দেরি করো না। উত্তম নামটা লাগিয়ে দাও। লেগে যাবে।’
তা-ই হলো। লেগে গেল। হিট হলো বসু পরিবার। বাঙালি পেয়ে গেল এক নতুন নায়ক—উত্তম কুমার। [তথ্যসূত্র: এক এবং অদ্বিতীয়, ডিসেম্বর, ২০১২ সংখ্যা, সাইন ইন্ডিয়া সিনেভিশন অ্যান্ড মিডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা]
এই উত্তম কুমার বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা। মহানায়ক হিসেবে যাঁর খ্যাতি আকাশছোঁয়া। আজ ২৪ জুলাই এই মহানায়কের প্রয়াণের ৩৭তম বার্ষিকী। ১৯৮০ সালের এই দিনে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
উত্তম কুমারের জন্ম উত্তর কলকাতার আহিরীটোলায়। মামাবাড়িতে। ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। তখন তিনি উত্তম কুমার নন। অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। কলকাতার গিরিশ মুখার্জি রোডের বাসিন্দা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়ের বড় ছেলে। ১৯৪২ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাস করলেন। ১৯৪৫ সালে বিকম স্ট্যান্ডার্ড পাস করে ভর্তি হলেন কলেজে। কিন্তু কলেজে পড়া আর এগোল না বেশি দূর। টানাপোড়েনের সংসার। চলল চাকরির সন্ধান। যেমন করেই হোক যেমন-তেমন একটি চাকরি! অবশেষে মিলল চাকরি। পোর্ট কমিশনার্স অফিসের খিদিরপুর ডকে। সাধারণ কেরানি পদে। বেতন মাসিক ২৭৫ টাকা। দুই হাজার টাকা জামানত দিয়ে চাকরিতে যোগ দিলেন তিনি। এরই মধ্যে চলছিল তাঁর অভিনেতা হওয়ার নিরলস প্রয়াস। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড থিয়েটার অনুরাগী। সেই ছোটবেলা থেকেই। ছিলেন যাত্রার ভক্ত। পড়ালেখা ফাঁকি দিয়ে চুরি করে দেখতেন থিয়েটারের রিহার্সেল। দেখতেন যাত্রারও রিহার্সেল। স্কুলের বার্ষিক উৎসবে গয়াসুর নাটকে ছোট গয়াসুরের ভূমিকায় অভিনয় করে হইচই ফেলে দিলেন। অভিনয়ের প্রতি ঝোঁকটা বেড়েই চলল ক্রমশ। মনের গহিনে চলল সোনালি স্বপ্ন বুনন, রুপালি পর্দায় অভিনয় করার। লালিত স্বপ্ন দেখা দিল বাস্তব হয়ে। অচিরেই মিলল সুযোগ। ১৯৪৭ সাল। বাড়ির ভাড়াটে গণেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে ভোলানাথ আঢ্যের ‘মায়াডোর’ নামের একটি হিন্দি ছবিতে ছোট্ট একটা রোল পেলেন অরুণ। দৈনিক পাঁচ সিকি পারিশ্রমিকে পাঁচ দিন অভিনয় করলেন। কিন্তু ‘মায়াডোর’ মুক্তি পায়নি। দ্বিতীয় সুযোগটি এল ঠিক পরের বছরই। ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে অভিনয় করলেন নায়কের ছোটবেলার ভূমিকায়। কমিশন বাদ দিয়ে এ ছবিতে তাঁর পারিশ্রমিক দাঁড়াল সাড়ে ১৩ টাকা। ওই বছরের মাঝামাঝি তিনি কাজ শুরু করলেন নবেন্দুসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘কামনা’ ছবিতে। নায়কের ভূমিকায়। পারিশ্রমিক ১ হাজার ৫০০ টাকা। ১৯৪৯ সালে মুক্তি পেল ‘কামনা’। কিন্তু সুপারফ্লপ। ভীষণ মুষড়ে পড়লেন তিনি। এরপর সরোজ মুখার্জির ‘মর্যাদা’ ছবিতে অভিনয় করলেন নায়ক হিসেবে। তবে পরিচালকের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নাম পাল্টে অরুণ কুমার হয়ে গেলেন অরূপ কুমার। কাজ হলো না। দর্শকপ্রিয়তা পেল না ছবিটি। আবার নাম পরিবর্তন করা হলো। উত্তম কুমার। ‘সহযাত্রী’ ছবিতে উত্তম কুমার নামে অভিনয় করলেন। অসফল হলো ছবিটি। অসফলতার ধারাবাহিকতায় যোগ হলো আরও একটি ছবি ‘নষ্টনীড়’। এরপর ‘সঞ্জীবনী’ এবং ‘কার পাপে’। শেষে ‘বসু পরিবার’। সেটা ১৯৫২ সাল। আশাতীত সাফল্য পেল ‘বসু পরিবার’। ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। এল ১৯৫৩। মুক্তি পেল তাঁর ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। ছবির নায়িকা সুচিত্রা সেন। সুপারহিট। এরপর শুধুই সাফল্য। ইতিহাস। নায়ক উত্তম কুমার হয়ে উঠলেন মহানায়ক উত্তম কুমার।
উত্তম কুমারউত্তম কুমার ছিলেন একাধারে অভিনেতা, সুরকার, প্রযোজক ও পরিচালক। তাঁর চলচ্চিত্রজীবন ৩০ বছরের। এই সময়টাতে তিনি অভিনয় করেছেন প্রায় ২০১টি ছবিতে। তাঁর বিপরীতে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছেন ৩৫ জন অভিনেত্রী। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে অভিনয় করেছেন ২৯টি ছবিতে। তবে সর্বাধিক ৩২টি ছবিতে অভিনয় করেছেন সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে। চলচ্চিত্র ছাড়াও অভিনয় করেছেন মঞ্চে ও যাত্রায়। এ ছাড়া পরিচালনা করেছেন পাঁচটি ছবি, সুরারোপ করেছেন দুটিতে আর প্রযোজনা করেছেন সাতটি ছবি। ‘হ্রদ’, ‘হারানো সুর’, ‘সপ্তপদী’, ‘নায়ক’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘গৃহদাহ’, ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘স্ত্রী’, ‘অমানুষ’, ‘বহ্নিশিখা’ ও ‘আনন্দ আশ্রম’ ছবিতে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য তিনি পেয়েছেন বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, সার্টিফিকেট অব মেরিট, ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড, সাংস্কৃতিক সাংবাদিক সংস্থা, প্রসাদ পত্রিকা ও ভরত পুরস্কার।
উত্তম কুমারের অভিনয়ের মূল্যায়ন করেছেন তাঁর সহকর্মীরা। নানাভাবে, নানা বিশেষণে। বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম দিকপাল সত্যজিৎ রায় তাঁকে মূল্যায়ন করেছেন ঠিক এভাবে, ‘বাংলা ফিল্মে উত্তম এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ওঁর মতো কেউ ছিল না, ভবিষ্যতেও আসবে না।’ অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের ভাষায়, ‘এককথায় বলতে গেলে তাঁর মতো শিল্পী পাওয়া খুব কঠিন। তবে আমার এটাও মনে হয়, তাঁকে কেউ ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারেনি।’
আর নিজের অভিনয় সম্পর্কে মূল্যায়ন শুনুন উত্তম কুমারের নিজের মুখে, ‘ধরাবাঁধা ছকে অথবা সাজানো কণ্ঠে অভিনয় করার ইচ্ছা আমার কোনো দিনই ছিল না। আমি তাই নিজস্ব ধারায় সহজ অভিনয় করতাম। আমরা যেমন করে কথা বলি, রাগ করি, ঠিক তেমনি সহজ অভিনয়। অভিনয় নয়, ভাবেই চরিত্র রূপায়ণ।’
[তথ্যসূত্র: আমার আমি, অনুলেখক: গৌরাঙ্গ প্রসাদ ঘোষ, দেশ পাবলিশিং, কলকাতা, নভেম্বর, ১৯৮৮]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *