মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমান খানকে আটকের বিস্তারিত ঘটনা সামনে এসেছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার ঘটনার বিবরণ দিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিটি প্রকাশ করেছে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে ইংরেজিতে প্রকাশিত
ওই বিবৃতির অনুবাদ এখানে তুলে ধরা হলো:-
১৯শে জুলাই ২০১৭, আনুমানিক রাত ১১টায় (বাংলাদেশ সময়) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং অধিকারের সেক্রেটারি মি. আদিলুর রহমান খান কুয়ালালামপুরগামী মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে (এমএইচ ১১৩) ওঠেন। এন্টি-ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক (এডিপিএন) এর দ্বিতীয় সাধারণ অধিবেশন বৈঠকে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে তিনি যাত্রা করেন। অধিকার এডিপিএএন-এর সদস্য। ২০শে জুলাই মালয়েশিয়ান সময় ভোর ৪টা ৫০ মিনিটে তিনি কুয়ালালামপুর ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরে (কেএলআইএ) পৌঁছান। এদিন সকালেই ওই বৈঠকটি শুরু হওয়ার নির্ধারিত সময় ছিল।
ইমিগ্রেশন ডেস্কে তিনি যখন তার পাসপোর্ট দেন তখন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা তার নাম ডাটাবেজে প্রবেশ করানোর পর আদিলকে এক টুকরো কাগজ দেন যেখানে বাহামা মালয়েশিয়া ভাষায় দুটো শব্দ লেখা ছিল। পরবর্তীতে মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রতিনিধিরা তাকে জানিয়েছিলেন যে ওই শব্দদুটির অর্থ ছিল ‘সন্দেহভাজন’ (সাসপেক্ট)। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা তার পাসপোর্টও ফিরিয়ে দেন এবং নিকটবর্তী একটি কক্ষে এক কর্মকর্তার কাছে যাচাইয়ের জন্য পাসপোর্ট জমা দেয়ার নির্দেশনা দেন।
দ্বিতীয় ওই কর্মকর্তার কাছে পাসপোর্ট জমা দেয়া পর আদিলকে অপেক্ষা করতে হয়। এ সময় পুলিশ একটি ফোন কল করে এবং নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। তার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানায় পুলিশ। আনুমানিক সাড়ে সাতটার দিকে তাকে অপর একজন ইমিগ্রেশন পুলিশ কর্মকর্তাকে অনুসরণ করতে বলা হয়। আদিলকে যখন বিমানবন্দরের অপর প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন তিনি এডিপিএন-এর একজন সমন্বয়ককে তার ফোন থেকে ইমেইল করতে সক্ষম হন। এক বাক্যে তিনি তাকে জানান যে তাকে বিমানবন্দরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না এবং সম্ভবত তাকে আটক করা হবে। সঙ্গে সঙ্গেই ইমেইলের জবাব পান তিনি। এতে ওই সমন্বয়কের মালয়েশিয়ান সহকর্মীর ফোননম্বর ছিল। তিনি ফোনে কথা বলতে পেরেছিলেন এবং ওই ব্যক্তি আদিলকে জানান যে তিনি অবিলম্বে ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনকে বিষয়টি অবহিত করছেন। আদিল তাকে সুয়ারাম’কেও (মালয়েশিয়ার স্থানীয় একটি মানবাধিকার সংস্থা) অবহিত করতে বলেন যেহেতু সুয়ারাম অধিকারের মতো একই আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সদস্য ছিল।
লক-আপে আদিলকে তার জুতা খুলতে বলা হয় এবং সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র আলাদা করে রাখতে বলা হয়। তার সেলফোন ও ল্যাপটপ সরিয়ে নেয়া হয়। এরপর তাকে বড় একটি কক্ষে আটক করা হয় যে কক্ষটি শুধু ইলেক্ট্রনিক পাসওয়ার্ড দিয়ে খোলা যায়। ওই কক্ষে আনুমানিক ৬০ জন ব্যক্তি ছিল। এদের বেশিরভাগ ছিল বাংলাদেশি। অন্যরা ছিল ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিস্তিন ও ইরান থেকে। আফ্রিকা মহাদেশ থেকেও কিছু লোক ছিল।
এক ঘণ্টা পর তাকে লক-আপ থেকে বের করে নেয়া হয় এবং খাবারের জন্য তাকে ৩৫০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত বা ১০০ মার্কিন ডলার দিতে বলা হয়। আর তাকে দেয়া হয় দুটি বিস্কিট, এক বোতল পানি, একটি টুথব্রাশ, টুথপেস্ট এবং একটি সাবান। এরপর তাকে ফের ওই কক্ষে পাঠানো হয়। ওই লক-আপের একমাত্র টয়লেট ব্যবস্থা ছিল নোংরা এবং কক্ষের আয়তন এতো মানুষের জন্য অপর্যাপ্ত।
আনুমানিক দুপুরের দিকে, এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে আদিলকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি এই আটকবস্থা নিয়ে বাইরের কাউকে অবহিত করেছেন কিনা। আদিল জানান, তাকে যখন লক-আপে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন তিনি এক বন্ধুকে অবহিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তার সেলফোন নিয়ে নেয়ার আগে। ওই কর্মকর্তা এরপর জোরে বলে ওঠেন, ‘কেন আপনি এটা করেছেন?’ কিছুক্ষণ পর আরেকজন কর্মকর্তা আসেন এবং আদিলকে জানান যে মালয়েশিয়ান ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন থেকে বন্ধুরা তার অবস্থান সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। তিনি আরো জানান যে ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টে তার বস নিশ্চিত হতে চেয়েছেন যে তিনি আদিলুর রহমান খান কি না এবং সেটা হিউম্যান রাইটস কমিশনের কাছে অবহিত করতে বলেছেন। তিনি তার সেলফোনে আদিলের একটি ছবি তোলেন।
বিমানবন্দরের বন্দিশালাটি বেসরকারিভাবে পরিচালিত এবং এর একজন কর্মকর্তা এসে আদিলকে পৃথক আরেকটি কক্ষে নিয়ে যান যেটার আকৃতি আনুমানিক ৬ ফিট বাই ১০ ফিট। সেখানে তাকে এক কাপ চা এবং মধ্যাহ্নভোজ দেয়া হয় যার জন্য তিনি অর্থ দিয়েছিলেন। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তাকে সেখানে আটক রাখা হয়। এ সময়ে তাকে বড় ও প্রধান আটক কক্ষের টয়লেটটি ব্যবহার করতে হয়। ৬টার সময় তাকে প্রথম যেই কক্ষে অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছিল (বড় আটককক্ষে নেয়ার আগে), সেই কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হিউম্যান রাইটস কমিশনের দু’জন প্রতিনিধিকে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি দেয়া হয়। তারা তাকে জিজ্ঞাসা করেন তাকে আটক করা হবে এমনটা বলা হয়েছে কি না। তিনি উত্তর দেন যে পুলিশ এমনটা তাকে বলেনি। তারা তাকে জানান যে, একজন আইনজীবী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বিমানবন্দরে এসেছেন, কিন্তু তাকে সে অনুমতি দেয়া হয়নি। সকালে মালয়েশিয়ান ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের একটি দলও এসেছিল। তাদেরও অনুমতি দেয়া হয়নি। ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রতিনিধিদের কাছে আদিল যা কিছু ঘটেছে তা জানান এবং প্রথম ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার দেয়া কাগজের টুকরোটি হস্তান্তর করেন। তারা যখন কথা বলছিলেন তখন একজন পুলিশ সদস্য এসে তাদের ছবি তুলে নিয়ে যায়।
তিরিশ মিনিট আলোচনার পর তাকে আটক এলাকার অভ্যর্থনার জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যা ৭টায় তাকে বোর্ডিং গেটে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ঢাকাগামী মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট এমএইচ১১২ তে উঠিয়ে দেয়া হয়। তার পাসপোর্ট তাকে দেয়ার পরিবর্তে ফ্লাইটের একজন ক্রু মেম্বারের কাছে দেয়া হয়। বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ২০ মিনিটে ঢাকায় পৌঁছালে, বাংলাদেশি একজন বিমানবন্দর কর্মকর্তা তাকে ইমিগ্রেশন পুলিশ কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানে আনুমানিক ১৫ মিনিট ছিলেন তিনি। তাকে তার পাসপোর্ট ফেরত দেয়া হয় এবং তিনি বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আসেন। তাকে আটক করা এবং এরপর ফেরত পাঠানোর প্রকৃত কারণ তিনি এখনও জানেন না। মালয়েশিয়ান ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন বিষয়টি তদন্ত করছে।
কেএলআইএ বন্দিশালায় আদিল লক্ষ্য করেন যে আটক যাদের কাছে খাবার কেনার অর্থ ছিল না তারা ট্যাপের পানি খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করছিলেন। সেখানকার কর্মকর্তারা আটক ব্যক্তিদের প্রতি রূঢ় ছিল। এমন মন্তব্যও তারা করছিল যে ‘নো মানি-নো ফুড’। সেখানে থাকা বাংলাদেশিরা তাকে বলেন যে, তাদের পরিবার জানে না যে তারা কোথায়? আর কর্মকর্তারা ফোন কল করতে দেয়ার বিনিময়ে অর্থ নিচ্ছিল। তাছাড়াও, আটক অনেকে দাবি করেন যে তাদের কাছে স্থানীয় মালয়েশিয়ান দূতাবাস কর্তৃক ইস্যুকৃত বৈধ ভিসা রয়েছে; তারপরও তাদের আটক রাখা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, এক নারী মালয়েশিয়া গেছেন তার স্বামীর সঙ্গে থাকার জন্য যিনি দেশটিতে ১১ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন। ওই নারীকে ভিসা প্রদান করে ঢাকাস্থ মালয়েশিয়ান দূতাবাস। কিন্তু তাকে আটক করে আদিলের সঙ্গে ঢাকায় ফেরত পাঠানো হয়।