লোকসান কমিয়ে আনা, খেলাপি ঋণ থেকে আদায় বৃদ্ধিসহ বেশকিছু সূচকে উন্নতির মাধ্যমে গত অর্থবছরে আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দেয় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। তবে বড় ঋণখেলাপি গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংকটি।
জানা গেছে, ২০০৮-১৩ সাল পর্যন্ত সময়ে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কৃষি ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের শীর্ষ গ্রাহকদের ৯০ শতাংশই বর্তমানে খেলাপি।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের কৃষি খাতের সম্প্রসারণ ও কৃষকদের ভাগ্যবদলে কাজ করে আসছিল বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। কিন্তু সাবেক চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোখতার হোসেনের হাত ধরে ২০০৮ সাল থেকে পুরোদমে বাণিজ্যিক ব্যাংকিংয়ে নামে কৃষি ব্যাংক। কৃষিঋণ থেকে সরে এসে বড় অংকের বাণিজ্যিক ঋণ দেয়া হয় ব্যবসায়ীদের, যা খেলাপি হয়ে পড়ে।
কৃষি ব্যাংকের খেলাপিদের মধ্যে সবার শীর্ষে রয়েছেন ফেয়ার ইয়ার্ন গ্রুপের স্বত্বাধিকারী মো. জসিম আহমেদ। ঋণখেলাপি এ গ্রাহকের কাছে ব্যাংকটির পাওনার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা। বড় অংকের ওই ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। অন্য বড় খেলাপিদের মধ্যে কেয়া ইয়ার্ন মিলস লিমিটেডের কাছে ১৩৩ কোটি টাকা, এসএ গ্রুপের কাছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা, আনিকা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলীর কাছে ১০১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা, গাড়ি ব্যবসায়ী মো. ওয়াহিদুর রহমানের ফিয়াজ গ্রুপের কাছে ১১৭ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে কৃষি ব্যাংকের। এছাড়া রহমান ট্রেডিংয়ের কাছে ৬২ কোটি ৭২ লাখ, মনো ব্যাগ লিমিটেডের কাছে ৫২ কোটি ৩২ লাখ টাকা, আব্বাস ট্রেডিংয়ের কাছে ৩১ কোটি, মনো ফিড মিলস লিমিটেডের কাছে ৩৩ কোটি এবং এনএ করপোরেশনের কাছে ২৬ কোটি টাকা বহুদিন আগেই খেলাপি হয়ে পড়েছে। বড় অংকের এসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে।
এ বিষয়ে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, ২০০৮-১৩ সাল পর্যন্ত কৃষি ব্যাংকের তত্কালীন নীতিনির্ধারকরা কোন বিবেচনায় আগ্রাসী বাণিজ্যিক ব্যাংকিং করেছেন, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। এ দেশের কৃষকরা খেলাপি হলেও ব্যাংকঋণ পরবর্তীতে ফেরত দেন। কিন্তু বড় গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা আদায় কঠিন।
তিনি বলেন, আদালতে মামলা চালিয়ে বড় খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের সম্ভাবনা নেই। এজন্য সবচেয়ে বড় খেলাপি ফেয়ার ইয়ার্নের মালিক মো. জসিম আহমেদ, কেয়া ইয়ার্ন মিলের মালিক আব্দুল খালেক পাঠান, ফিয়াজ গ্রুপের মালিক মো. ওয়াহিদুর রহমানসহ শীর্ষ খেলাপি গ্রাহকদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে অর্থ আদায়ের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো চালু করে খেলাপি গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে হবে। এজন্য ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপি গ্রাহকদের ঋণ পুনঃতফসিল করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। কিছু গ্রাহক এরই মধ্যে পুনঃতফসিল করার জন্য এগিয়ে এসেছেন। অন্যরাও এগিয়ে আসবেন বলে আশা করছি।
এদিকে বড় খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে না পারলেও সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে কৃষি ব্যাংক। ব্যাংকটির তথ্যমতে, গত অর্থবছরে কৃষি ব্যাংক খেলাপি ঋণ থেকে আদায় করেছে ১ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে খেলাপি ঋণ থেকে ১ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা আদায় করেছিল ব্যাংকটি। খেলাপি থেকে আদায় বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে ৫৯৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ২৭১ কোটি টাকায় নেমে এসেছে, যা গত বছরের জুনে ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বর্তমানে কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
খেলাপি ঋণ কমায় বেড়েছে কৃষি ব্যাংকের আয়। ফলে কয়েক বছর ধরে অব্যাহত লোকসান বাড়তে থাকা ব্যাংকটির লোকসানের পরিমাণ গত অর্থবছরে কমে এসেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কৃষি ব্যাংকের নিট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫১০ কোটি টাকা। যদিও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৭৮ কোটি টাকা নিট লোকসানে ছিল ব্যাংকটি।
চলতি বছরের জুন শেষে কৃষি ব্যাংকের লোকসানি শাখার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৩টি। এর আগে ২০১৬ সালের জুনে ব্যাংকটির লোকসানি শাখা ছিল প্রায় ২৪০টি। তবে ধারাবাহিক লোকসানে থাকায় কমেনি কৃষি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি। জুন শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
সার্বিক উন্নতির বিষয়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রায় সবক’টি সূচকে কৃষি ব্যাংক ভালো করেছে। তবে জনবল সংকটের কারণে পূর্ণউদ্যমে ব্যাংকের কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে না। এছাড়া বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনায় কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগ্যতার ঘাটতিও রয়েছে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে কৃষি ব্যাংক গ্রাহকদের সুদহার কমিয়েছে ও সুদ মওকুফ করেছে। কিন্তু সরকার তার বিপরীতে ব্যাংককে কোনো ভর্তুকি দেয়নি। ফলে সরকারের কাছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা সুদ মওকুফ বাবদ দাবি করা হয়েছে। সরকার এ টাকা দিলে আমাদের মূলধনের পরিমাণ বাড়বে। সরকার থেকে ঘাটতি মূলধনের জোগান পেলে ব্যাংক শক্ত আর্থিক ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারবে।
চলতি বছরের জুন শেষে কর্মচারী ঋণসহ কৃষি ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৭ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে কৃষি ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ৬ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। এর আগের বছর ৫ হাজার ৯২১ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছিল ব্যাংকটি। সে হিসাবে গত অর্থবছরের তুলনায় কৃষি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ প্রায় ৭ শতাংশ বেড়েছে।
চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে ২১ হাজার ১৮২ কোটি টাকা আমানত ছিল ব্যাংকটির।