এখন হাতের মুঠোয় পৃথিবী। হাতের মুঠোয় পর্ন। এক সময় পর্ন দেখতে হলে কাকপক্ষী যেন না দেখে, এমন করে লুকিয়ে রাস্তায় বিক্রির জন্য রাখা পিন-আপ কোনও ম্যাগাজিন দ্রুত খুলে দ্রুত বন্ধ করে ফেলতে হতো। আর সেসব ম্যাগাজিন কিনলে কাগজে ভালো করে মুড়িয়ে বাড়ি ঢুকতে হতো, রাতের অন্ধকারে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে পড়তে হতো, পড়ে দিনের আলো ফোটার আগেই চালান করে দিতে হতো বড় তোশকের তলায়। এর পর ভিডিওর যুগ এলো। চাদরে মুখ মাথা ঢেকে রাতের অন্ধকারে পা টিপে টিপে কোনও গলি ঘুপচির ভেতর সেঁধিয়ে স্যাঁতসেঁতে কোনও ঘরে ঢুকে বিস্তর টাকা পয়সা ঢেলে ‘নীল ছবি’ দেখতে হতো। সেই দিন আর নেই। যখন ইচ্ছে তখন পর্ন দেখার যুগ এখন। পর্ন এখন হাতের কাছে তো বটেই, মাত্র এক ক্লিক দূরত্বে।
যে ‘নীল ছবি’গুলোয় নারীকে যৌনদাসী হতে হয়, পুরুষ যেমন ইচ্ছে তেমন ক’রে ভোগ করে নারীকে, নারীকে যন্ত্রণা দিতে দিতে ভোগ করে, আর নারীকে মিথ্যে করে বলতে হয় যে সে আরও যন্ত্রণা চায়, চায় কারণ তার খুব ভালো লাগছে এসব যন্ত্রণা, যে নীল ছবিগুলোয় অরগাজম শুধু পুরুষের জন্য, নারীর জন্য নয়— সেগুলোকে আমি পর্ন বলি। আর যেগুলোয় নারী-পুরুষের প্রেমময় যৌনতা দেখানো হয়, সেগুলোকে বলি ইরোটিকা। ইরোটিকাগুলোকে আজকাল বলা হচ্ছে ‘ফিমেল ফ্রেন্ডলি পর্ন’। পুরুষের পর্নগুলো ভায়োলেন্সে ভরপুর। আর ‘ফিমেল ফ্রেন্ডলি’গুলোয় ভায়োলেন্সের চিহ্ন নেই। কবে ‘মেইল ফ্রেন্ডলি’গুলোয় দেখবো ভায়োলেন্স নেই? নাকি ভায়োলেন্স থাকলেই তাকে বলা হয় ‘মেইল ফ্রেন্ডলি’? পুরুষ নামের সঙ্গে কী ভয়ানকভাবে যুক্ত হয়ে আছে নিষ্ঠুরতা আর বর্বরতা!
আজকাল পর্ন সাইটগুলোয় দেখছি প্রচুর বাঙালি ছেলে-মেয়ের ভিডিও। কিছু ভিডিও দেখলে যে কেউ বুঝবে মেয়েটি জানে না যে তাদের রতিক্রিয়া রেকর্ড করা হচ্ছে। আবার কোনও কোনও ভিডিও দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে মেয়েটি বুঝতে পারছে না যে রেকর্ড করা ভিডিও ইন্টারনেটে দেওয়া হবে। মেয়েটির অনুমতি ছাড়া ভিডিওগুলো পৌঁছে যাচ্ছে চেনা অচেনা সবার কাছে।
আজকাল আরও শুনছি যে গোপনে যৌনক্রিয়ার ভিডিও করে ইন্টারনেটে প্রচার করার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছে কিছু লোক। প্রচুর টাকা দাবি করছে মেয়ের কাছে, মেয়ের আত্মীয়স্বজনের কাছে। বছর দেড়েক আগে এই ব্ল্যাকমেইল নিয়ে ‘দৃশ্যম’ নামে একটি সিনেমা বানানো হয়েছিল। একটি মেয়ে স্নানঘরে উলঙ্গ হয়ে স্নান করছিল, সেই স্নানের দৃশ্য একটি বদ ছেলে মোবাইল ফোনে রেকর্ড করে হুমকি দিয়েছিল যে মেয়েটি যদি তার সঙ্গে যৌনসম্পর্কে যেতে রাজি না হয় তবে ইন্টারনেটে সে মেয়েটির স্নানের ভিডিও ছড়িয়ে দেবে। এই নিয়ে কত খুনোখুনি হয়ে গেল। বাংলাদেশেও ধর্ষণ এবং প্রতারণা পুরোদমে চলছে। সেদিন বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স পাস করা মুজাহিদ নামের এক যুবক এক নারীকে ধর্ষণ করে ধর্ষণের ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার করবে বলে হুমকি দিয়েছে। সেই নারীটির স্বামীর কাছ থেকে এক কোটি টাকা চেয়েছে। মুজাহিদকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। জেনেছে সে এক পর্নগ্রাফি গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত। এদের কাজই হলো ব্ল্যাকমেইল করা।
এখন প্রশ্ন হলো, একটি পুরুষের উলঙ্গ শরীর অন্তর্জালে সবাই দেখলে পুরুষের জীবন তো বরবাদ হয়ে যায় না! একটি মেয়ের কেন যায়? নারী পুরুষের যৌনক্রিয়ার ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার হলে পুরুষের তো তেমন কোনও অসুবিধে হয় না, নারীর এত কেন অসুবিধে? কারোর, সে নারীর হোক, পুরুষের হোক, কোনও ভিডিও অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রচার করা উচিত নয়। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি ব্ল্যাকমেইল কেন শুধু মেয়েদেরই করা হয়? কোনও পুরুষকে তো হুমকি দেওয়া হয় না এই বলে যে তার উলঙ্গ শরীরের ভিডিও বা তার সেক্স ভিডিও ইন্টারনেটে আপ্লোড করা হবে? কারণ পুরুষকে তার শরীর ঢেকে রাখতে হয় না, নারীকে হয়। কারণ নারীর শরীরকেই নারীর একমাত্র সম্পদ বলে ভাবা হয়। সম্পদকে ঘাঁটলে, স্পর্শ করলে, এমনকি দেখলেও ভাবা হয় সম্পদের মূল্য কমে গেছে। মূল্য কমার ভয়ে নারীরা আতঙ্কে পাথর হয়ে থাকে। কেউ কেউ আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যা করে কারণ তাদের সেক্স ভিডিও অন্তর্জালে পাওয়া যাচ্ছে, তাদের শরীর যে কেউ দেখছে, এই শরীর আর পবিত্র নয়! অপবিত্র শরীরের গ্লানি আর লজ্জা তাদের কড়িকাঠের দিকে নিয়ে যায়।
সেক্স ভিডিও প্রচার হলে লজ্জা আর অস্বস্তি যদি হয়ও, তা নারী আর পুরুষের বেলায় সমান হোক, চাই। অনুমতি ছাড়া যারা সেক্স ভিডিও প্রচার করে, তাদের শাস্তি হোক চাই। কিন্তু মেয়েদের সেক্স ভিডিও প্রচার হলে মেয়েদের সর্বনাশ হয়ে যাবে, এই ভাবনা নারী-পুরুষ সবাইকে দূর করতে হবে। এটি যতদিন দূর না হচ্ছে, ততদিন ব্ল্যাকমেইল করার সুযোগ থেকেই যাচ্ছে। নারীর উলঙ্গ শরীর কেউ দেখে ফেললে শরীর পচে যায় না বা নষ্ট হয়ে যায় না। শরীর নিয়ে লজ্জা দূর করতে হবে। শরীরকে নারীর একমাত্র সম্পদ ভাবার মানসিকতাও দূর করতে হবে। নারীর আর সব রকম স্বাধীনতার মতো যৌন স্বাধীনতাও নারীর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। যৌন স্বাধীনতা থাকা মানে যৌনতায় রাজি হওয়ার স্বাধীনতা, আবার রাজি না হওয়ার স্বাধীনতাও। যৌন স্বাধীনতা থাকা মানে সেক্স ভিডিও ইন্টারনেটে দেওয়ার স্বাধীনতা, আবার না দেওয়ার স্বাধীনতাও। নারীর যৌন স্বাধীনতাকে আবহমান কাল ধরে লংঘন করছে পুরুষেরা। কবে তারা বন্ধ করবে তাদের বর্বরতা?
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।