শর্তের জালে আটকা পড়েছেন মালয়েশিয়ায় বৈধতার চেষ্টায় থাকা অবৈধ বা আন-ডকুমেন্টেড বাংলাদেশিরা। দেশটির তরফে বাংলাদেশিদের জন্য দু’টি বিকল্প শর্ত দেয়া হয়েছে। প্রথমত: ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলমান রি-হায়ারিং বা পুনর্নিয়োগের সুযোগ নেয়া। দ্বিতীয়ত: থ্রি প্লাস ওয়ান অর্থাৎ ভেলিড ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ, ৪শ’ রিংগিত জরিমানা ও দেশে ফেরত। পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, প্রথম শর্ত অর্থাৎ রি-হায়ারিংয়ের সুযোগই নিতে চায় বাংলাদেশ। এ নিয়ে বাংলাদেশ কমিউনিটিতে রীতিমতো ক্যাম্পেইনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কুয়ালামপুরস্থ বাংলাদেশের হাই কমিশনার মো. শহীদুল ইসলাম। গতকাল সন্ধ্যায় মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, সোমবার ডিজি ইমিগ্রেশন দাতুক সেরি মুস্তাফা আলীর সঙ্গে আমাদের বৈঠক ছিল। সেই বৈঠকে আশ্বস্ত হয়েছি ই-কার্ডের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যেসব বাংলাদেশি তা সংগ্রহ করতে পারেননি তারাও পাসপোর্ট এবং নিয়োগকর্তা জোগাড় করে রি-হায়ারিংয়ের প্রক্রিয়ায় বৈধ হওয়ার সুযোগ নিতে পারবেন। মানবজমিনসহ দেশি-বিদেশি মিডিয়ার মাধ্যমে এখন আমরা প্রত্যেক বাংলাদেশির কাছে সেই বার্তা দিতে চাই। বলতে চাই, আপনারা আতঙ্কিত হবেন না। ই-কার্ডবিহীনরাও রি-হায়ারিংয়ের সুযোগ নিতে পারবেন। যাদের পাসপোর্ট বা বৈধ কোনো ডকুমেন্ট আদৌ ছিল না, এখনও নেই, তারা কিভাবে রি-হায়ারিংয়ের অপরিহার্য শর্তগুলো পূরণ করে সুযোগটি নিবেন? জবাবে হাই কমিশনার বলেন, তাদের জন্যও একটি প্রক্রিয়া আছে। ই-কার্ডবিহীনরা মিশন থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে পারবেন। আর মালয়েশিয়ার সরকার নির্ধারিত ৩টি কোম্পানির মাধ্যমে কোনো না কোনো নিয়োগকর্তার অধীনে কাজ নেবেন। পাসপোর্ট এবং নিয়োগকর্তার কাগজপত্র এ দু’টি অপরিহার্য শর্ত পূরণ করলেই তারা রি-হায়ারিংয়ের প্রক্রিয়ায় বৈধতার সুযোগ নিতে পারবেন। অবশ্য বাংলাদেশ মিশনের অন্য একটি সূত্র মানবজমিনকে জানিয়েছে, ডিজি ইমিগ্রেশনের সঙ্গে সোমবারের বিশেষ বৈঠকে বাংলাদেশ মিশনের ডেপুটি হাই কমিশনার এবং শ্রমবিভাগের এক কর্মকর্তা অংশ নিয়েছিলেন। সেই বৈঠকে মোটাদাগে দু’টি বিষয় আলোচনা হয়েছে। প্রথমত: বৈধতার চলমান প্রক্রিয়া, দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশিসহ সাম্প্রতিক অভিযানে আটক বিদেশিদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো। সেই বৈঠকটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেখানে ভারত, নেপালসহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের পদস্থ কর্মকর্তারা অংশ নেন। সভায় ডিজি ইমিগ্রেশন বলেন, ই-কার্ডের সময় বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত নেই। তবে রি-হায়ারিং চালু আছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই অবৈধদের সুযোগটি নিতে হবে। ডিসেম্বরের পর এটিও আর বাড়ানো হবে না। বৈঠকে ধরপাকড় প্রসঙ্গে তিনি স্পষ্ট করেই বলেন, এটি একান্তই আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটি বন্ধ হয়নি। নিয়মিত বিরতিতে অভিযান চলবে। বৈঠকে এ প্রসঙ্গে ডিজি আরো বলেন, নানা কারণে অবৈধ হওয়া বিদেশি নাগরিকদের বৈধতার জন্য বারবার আহ্বান জানানো হয়েছে। দূতাবাসগুলোও কাজ করছে। সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিক ই-কার্ড সংগ্রহ এবং রি-হায়ারিংয়ের সুযোগ নেয়ার জন্য নিবন্ধিত হওয়ায় ডিজি বৈঠকে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এ পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ৯৩ হাজার বাংলাদেশি রি-হায়রিংয়ের জন্য নিবন্ধিত হয়েছেন এবং ১ লাখের বেশি ই-কার্ড সংগ্রহ করেছেন জানিয়ে রাষ্ট্রদূত মো. শহীদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা ই-কার্ড এবং রি-হায়ারিংয়ের সুযোগ নিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশি এ সুযোগ নেয়ার জন্য নিবন্ধিত হয়েছেন। এখনও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এ প্রক্রিয়ার বাইরে রয়েছেন বলে জানান তিনি। তবে সেই সংখ্যা কত হবে- তা নিয়ে কোনো অনুমানে যেতে চাননি রাষ্ট্রদূত। বলেন, আমরা প্রতিদিন প্রায় দু’ থেকে আড়াই হাজার লোককে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। সরকারের তরফে মিশনকে সর্বোতভাবে সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
ই-কার্ড সংগ্রহে ব্যর্থ নিয়োগকর্তারা আইনের আওতায় আসছেন: কুয়ালালামপুরের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, অবৈধ শ্রমিক রেখেছেন অথচ নির্ধারিত সময়ে ই-কার্ড সংগ্রহ করেননি এমন নিয়োগকর্তাকে আইনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালয়েশিয়ার সরকার। ডিজি ইমিগ্রেশনের বৈঠকে এ বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা দেয়া হয়েছে। জানানো হয়েছে, কেন কর্মীদের ই-কার্ড করায়নি এ জন্য নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে শাস্তিও দেয়া হয়েছে। তবে যারা কার্ড করেছেন, এমন কোম্পানি বা নিয়োগকর্তা ইমিগ্রেশনে অবৈধদের নামের তালিকা পাঠালে তাদের যাতে পুলিশ হয়রানি করতে না পারে সেই ব্যবস্থা নেবে মালয়েশিয়ার সরকার। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ই কার্ড যারা করেছেন তারা এক বছর সময় পাবেন। এই সময়ের মধ্যে তারা রি-হায়ারিংয়ের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বৈধতা পাবেন। মালয়েশিয়ায় প্রবেশকারী বিদেশি নাগরিক যাদের পাসপোর্ট পূর্বে ছিল না এখনও নেই এমন তালিকায় থাকা বাংলাদেশিদের জন্য ই-কার্ড ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয় সুযোগ। কিন্তু অনেকেই তা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেই সংখ্যা ৮০ হাজার থেকে এক লাখ হতে পারে বলে ধারণা দেন ওই কর্মকর্তা।
রি-হায়ারিংয়ের যত শর্ত: রি-হায়ারিংয়ের জন্যও অনেক শর্ত আরোপ করেছে মালয়েশিয়া। ডিজি ইমিগ্রেশনের বৈঠকে বলা হয়েছে, এ সুযোগটি তারাই নিতে পারবেন যারা কোনো কোম্পানিতে ন্যূনতম ৬ মাস ধরে কাজ করছে। এখন তাদের ভিসা নেই, আগে ভিসা ছিল এমন ব্যক্তিরা রি-হায়ারিংয়ের জন্য ‘মাই ইজি’, ‘বুক্তি মেঘা’ এবং ‘ইমান’ নামক তিনটি কোম্পানির যে কোনোটিতে নিবন্ধিত হবেন। তাদের অধীন কারখানা বা কোম্পানি বা নিয়োগকর্তা ছাড়া রি-হায়ারিং হবে না। এ প্রক্রিয়ার দ্বিতীয়ত শর্ত হচ্ছে বয়স ৪৫ বছর বা বেশি এবং আগের কোম্পানির কোনো অভিযোগ থাকলে রি-হায়ারিং করতে পারবে না। তৃতীয়ত: ওই কোম্পানির বিদেশি কর্মী নিয়োগের অনুমতি থাকতে হবে।
আটকদের দেশে ফিরতেও শর্ত: ডিজি ইমিগ্রেশনের বৈঠকে জানানো হয়েছে, সাম্প্রতিক অভিযানে আটক বিদেশি নাগরিকদের বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত হচ্ছে। তাদের বিষয়টি আদালতে যাবে। আদালতের নির্দেশনা মতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত হবে। সাধারণত পাসপোর্ট না থাকার জন্য পাসপোর্ট আইন, ভিসার জন্য ভিসা আইন অনুযায়ী বিচার হয়। সেই বিচারে তাদের শাস্তি হলে সেই শাস্তি ভোগ করেই দেশে ফেরত আসতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে মালয়েশিয়ার ডিটেনশন সেন্টারের প্রায় ১২০০ বাংলাদেশি আটকের তথ্য পেয়েছে ঢাকা। কিন্তু এদের অনেকের কাছেই বাংলাদেশি বলে বৈধ ডকুমেন্ট নেই। অনেক রোহিঙ্গাও এর মধ্যে থাকতে পারেন এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে ওই কর্মকর্তা বলেন, আটক প্রত্যেকের নাগরিকত্ব নিশ্চিত হওয়ার পরই তাদের ফেরত আনা হবে। তবে তাদের কোন প্রক্রিয়ায় কিভাবে ফেরত আনা হবে সেটি দুই সরকারের পরবর্তী আলোচনায় ঠিক হবে।