সিকিম সীমান্তে ভারত-চীন সংঘাত এশিয়ার দুই শক্তিধর রাষ্ট্রের অত্যন্ত জটিল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সংকটের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। কূটনীতিবিদরা বলছেন, ডোকলাম উপত্যকায় চীনের এতটা সক্রিয়তার পেছনে তিনটি কারণ কাজ করছে। প্রথমত, চীন তার সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়ে এশিয়ার একমাত্র শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে বদ্ধপরিকর। ভারত এই বশ্যতা স্বীকার করে না বলেই চীন তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে চায়। দ্বিতীয়ত, চীন এশিয়ায় স্বল্পমেয়াদি স্থায়িত্ব চায় না, কারণ তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন পরিকল্পনা অনেকটাই ইউরোপকেন্দ্রিক। তৃতীয়ত, চীনভিত্তিক নতুন এশীয় ব্যবস্থা কোনো অর্থনৈতিক যোগসূত্রের আধার নয়। বরং, একটি সামরিক ও রাজনৈতিক বিন্যাস, যেখানে বেইজিংয়ের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠাই একমাত্র লক্ষ্য।
বৃহস্পতিবার আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত-চীন দীর্ঘ সীমান্তের অধিকাংশ এলাকা নিয়েই রয়েছে বিতর্ক। একটা সময় ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সীমান্ত বিরোধ বিনিময়ের সূত্রে মীমাংসার সম্ভাবনা ছিল। দীর্ঘদিনে সে সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়েছে। এখন সমগ্র সীমান্তকে নিয়ে সমাধানের পথ খোঁজা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় এখন নানা অনিশ্চয়তা। সীমান্ত নিয়ে চীন ও ভারতের মানসিকতা ও চিন্তার মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। চীন ঔপনিবেশিক সীমান্তকে অবৈধ মনে করে। কিন্তু অতীতে বহুবার চীন তার সুবিধা মতো ব্রিটিশ স্বাক্ষরিত সীমান্তসংক্রান্ত নানা চুক্তিকে ব্যাখ্যা করেছে এবং প্রয়োজনে রদবদলও করেছে।
ভারতের অবস্থানও জটিল। দেশটি ম্যাকমোহন লাইনকে বৈধতা দিলেও, স্থানবিশেষে অবস্থান পাল্টেছে। এমনকি চীন ও ভারত কিন্তু তিব্বত, ভুটান ও সিকিমের প্রাচীন নথিপত্র ও প্রমাণকে প্রত্যাখ্যান করেছে। যে ডোকলাম ও চুম্বি উপত্যকাকে নিয়ে চলমান উত্তেজনা, তার একটা আঞ্চলিক ইতিহাস রয়েছে, যা দুই শক্তিশালী রাষ্ট্রের পরিভাষায় অনুপস্থিত। ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক প্রদীপ ফনজোবাম বলেন, ‘এ অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব নিয়ে নানা দাবি ক্রমে অতি সরলীকৃত হয়ে এক সরলরেখার দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত ধরে এই সরলীকরণের সূত্রপাত।’ চুম্বি উপত্যকা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাকি রাজ্যের যোগাযোগের একমাত্র অতি ক্ষীণ রাস্তার বুকে ছুরির মতো বিঁধে আছে। ফলে এ অঞ্চলকে নিয়ে ভারতের স্পর্শকাতরতা স্বাভাবিক। অন্যদিকে, তিব্বতে চীনের শাসন প্রশ্নাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত। তিব্বত-ভুটান বা তিব্বত-সিকিম সীমান্তকে চীন নিজেদের সীমান্তে পরিণত করেছে। ভারত তার বিরোধিতা করলে চীন স্বভাবতই সন্দিহান হয়ে ওঠে। যে সম্পর্কে পারস্পরিক বিশ্বাস সীমিত, এ ধরনের অনমনীয় মনোভাব সেখানে অনায়াসে বৈরিতা সৃষ্টি করবে এটাই স্বাভাবিক।
ভারত-চীন সম্পর্কের শীতলতা শুধু সীমান্ত বিরোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল আবর্তে তথা এশিয়া মহাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সম্পর্কের ওঠানামা করছে। ১৯৭৬ সাল থেকে চীনের লাগাতার অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে দেশটির সামর্থ্য বিপুল বেড়েছে। অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও ক্ষমতার কঠোর পরিকাঠামো এই শক্তির ভাণ্ডারকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই চীনের পররাষ্ট্রনীতিতে আত্মম্ভরিতা ও নিজের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আস্থা ফুটে উঠেছে বারবার। ফলে ভারত, জাপান, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।
দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিং আক্রমণাত্মক হয়েছে এবং ভারত মহাসাগরে দেশটির অবস্থান লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। স্বভাবতই জাপান, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশের সঙ্গে মিলে ভারত চীনের শক্তিকে প্রতিহত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন বহু গুণ মজবুত করে চীন ভারতের নিরাপত্তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। চীন-পাকিস্তান জোট গঠন দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাবকে সীমাবদ্ধ রাখার এক কৌশল। চীন ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে, যা ভারতের পক্ষে চিন্তার বিষয়। চীনের বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভার এই সম্পর্কগুলোর ধারক ও বাহক। কিন্তু বহু চীনা বিশেষজ্ঞের মতে, অধিকাংশ প্রতিবেশী রাষ্ট্রই বিভিন্ন উপায়ে বেইজিংকে প্রতিহত করতে আগ্রহী। ভারতের পূর্ব এশিয়া সংক্রান্ত পররাষ্ট্রনীতি পরিকল্পনায় চীনের বিরুদ্ধে শক্তিসাম্য গড়ে তোলা তাই এখন মুখ্য উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে। এই পটভূমিকায় চীনকে কেন্দ্র করে ভারতের উদ্বেগটাকে বুঝতে হবে।
এখানে চারটি বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, চীন ভারতকে তার প্রতিপক্ষ মনে করলেও তাকে মান্যতা দিতে নারাজ। তাই চীন নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ারস গ্রুপে (এনএসজি) ভারতের অন্তর্ভুক্তির ঘোরবিরোধী। চীন ভারতকে পরমাণু চুক্তিবহির্ভূত শক্তি হিসেবে দেখে।
অন্যদিকে ভারতের দাবির ভিত্তি হল পরমাণু প্রযুক্তির বিস্তার রোধে তার দায়িত্বশীলতা। দ্বিতীয়ত, চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ বা ও নিউ সিল্ক রুটের বিশাল কর্মকাণ্ড ভারতের সামনে আর একটি চ্যালেঞ্জ। এই পরিকল্পনার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক আকর্ষণ অনস্বীকার্য। কিন্তু এই প্রকল্পের মধ্যে ভারত প্রত্যক্ষ করে চীনের সামরিক প্রভাব বিস্তার ও কৌশলের নতুন এক পন্থা। ভারতের আপত্তির মূলে রয়েছে, চীনের ‘সর্বগ্রাসী মনোভাব’।
তৃতীয়ত, ভারত-চীন সম্পর্ক আমেরিকাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন যে ‘এশিয়ান পিভট’ অর্থাৎ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে এশিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধির ধারণা সামনে এনেছিলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উত্তর কোরিয়া নিয়ে চীন-মার্কিন পারদ চড়লেও, সামগ্রিকভাবে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নতুন সামরিক জোট গঠন করে বেইজিংকে দমিয়ে রাখার পরিকল্পনা আপাতত হিমঘরে। অতীতে ভারত চীনকে এশিয়া তথা বিশ্বের নানা যৌথ প্রকল্পে শামিল করে সহযোগিতার পথ খুঁজেছে। পাশাপাশি, নিজেদের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিবৃদ্ধি করে চীনকে প্রতিহত করতে চেয়েছে।
বর্তমান সংকটের সময়েও এ দ্বিফলা নীতি ভারতের সেরা বাজি। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে, বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও চীনের সুনাম বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। নেতৃত্বের নেশায় বিভোর চীন কি এই ঝুঁকি নেবে?
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, চীনের উত্থানের ফলে কি শক্তিধর রাষ্ট্রের অর্থ ও পরিভাষা বদলাতে চলেছে? চীন কি অন্য ধরনের মহাশক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করছে? হু জিনতাওয়ের আমলে ভাবা গিয়েছিল, চীনের অতিসক্রিয় পররাষ্ট্রনীতির মূলে ছিল কার্যত দেশটির বিরামহীন উন্নয়নের তাগিদ।
কিন্তু শি জিনপিংয়ের সময় চীনের সমৃদ্ধি অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রগাঢ় অর্থনৈতিক সম্পর্কের নিরিখে নির্মিত। এর একদিকে এশিয়ার সামগ্রিক উন্নয়নের অঙ্গীকার, অন্যদিকে সেই সামগ্রিকতার প্রয়োজনে ভিন্ন রাষ্ট্রে দখলদারির প্রবণতা। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, সীমান্ত সংকট হয়তো দুই এশীয় মহাশক্তির মধ্যে যুদ্ধ ডেকে আনবে না। কিন্তু দুই দেশের ভিন্নমুখী রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও পরিস্থিতিজাত বাধ্যবাধকতা তাদের সম্পর্কের তিক্ততাকে বাড়িয়ে তুলবে।