বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিলাসী জীবন, টাকার ভাগাভাগি, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ এবং কমিটির মেয়াদের বিষয়ে ওঠা অভিযোগ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
সারা দেশে চলমান নিজেদের কোন্দল-সংঘাতের মধ্যে গত বুধবার ছাত্রলীগের সাধারণ সভায় এই অভিযোগের সূত্রপাত করেন সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সায়েম খান। এরপর এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সিলেটে এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে সংগঠনের দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি কক্ষ ভাঙচুর করেছে।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান গতকাল প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, আগের দিন সাধারণ সভায় তাঁদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগকারী সায়েম খান তাঁর বক্তব্যের জন্য ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন।
তবে সায়েম খান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ক্ষমা চাননি। তাঁর ভাষ্য, ‘আমাকে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমি বলেছি, আমি যেটা বলেছি, এটাই ঠিক। আমি শুধু ছাত্রলীগের ফান্ডের টাকা, যেগুলো ছাত্রলীগের নামে আসে, সেটার নিয়মতান্ত্রিক ব্যয়ের কথা বলেছি। ছাত্রলীগ করে কেন শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ভালো থাকবে? অন্য নেতাদের দায়িত্বও তাঁদের নিতে হবে।’
গত বুধবার সাধারণ সভায় ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার তোপের মুখে পড়েন। বিক্ষুব্ধ নেতারা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে তাঁদের বিলাসী জীবনযাপনে অর্থের উৎস, সংগঠনের তহবিলে আসা অর্থ ও খরচের খাত সম্পর্কে জানতে চান। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি উন্নয়নকাজের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ বা টেন্ডারবাজি করে টাকা উপার্জনের অভিযোগও সভায় উত্থাপিত হয়। এসব টাকার ভাগও দাবি করেন এক নেতা।
জানতে চাইলে গতকাল ছাত্রলীগের সভাপতি প্রথম আলোকে বলেন, দু-একজন এমন অভিযোগ করলে, সেটা সত্য হয়ে যায় না।
সভায় উপস্থিত একাধিক সূত্র প্রথম আলোকেজানায়, সায়েম খানের প্রশ্নের জবাবে ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান জানান, তাঁদের খরচের টাকা প্রধানমন্ত্রী দেন। সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁদের মাসে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা দেন। তখন সায়েম খান বলেন, প্রধানমন্ত্রী টাকা দিলে সেই টাকার ভাগ তাঁরও আছে। তাঁকেও ভাগ দিতে হবে।
সায়েম খান ছাড়াও ছাত্রলীগের সহসভাপতি মেহেদী হাসান, আদিত্য নন্দী, মাকসুদ রানা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করেন। টাকার হিসাব চাওয়া নিয়ে সভার একপর্যায়ে হট্টগোলও হয়।
এর আগে ১৩ জানুয়ারি ছাত্রলীগের সভাপতি হেলিকপ্টারে করে ঈশ্বরদীতে কর্মশালা ও সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন। তখন বিলাসবহুল জীবন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন ছাত্রলীগ সভাপতি। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রকাশ্য সভায় সমালোচনা করেছিলেন।
চলতি মাসের ২৬ তারিখে ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বর্ধিত সভা করে মেয়াদ বাড়ানো হবে কি না, বুধবারের সাধারণ সভায় এ প্রশ্নও উঠেছিল।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গতকাল ছাত্রলীগের সভাপতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের যেদিন সম্মেলন দিতে বলবেন, সেদিনই সম্মেলন হবে।’
ছাত্রলীগের সম্মেলনের বিষয়টি গতকাল বিকেলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনেও উঠে আসে। এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দেশে এখন বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আমি বলতে পারি, খুব বেশি বিলম্বিত হবে না।’
বুধবারের সভায় কয়েকজন সারা দেশে ছাত্রলীগের যাঁরা অপকর্ম করে বেড়ান, তাঁদের বিরুদ্ধে সংগঠন কেন ব্যবস্থা নেয় না, তা-ও জানতে চান।
কোন্দল-সংঘাত সারা দেশে
ছাত্রলীগের এ বছরের শুরুটা হয়েছিল নিজেদের মারামারিতে, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ বন্ধের রেশ নিয়ে। পরের ছয় মাসে দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, ছিনতাই, পুলিশ কর্মকর্তাকে মারধর, শিক্ষক লাঞ্ছনা, অভ্যন্তরীণ সংঘাত, খুনসহ ৩৭টি ঘটনায় ছাত্রলীগ গণমাধ্যমের সংবাদ হয়েছে। যার মধ্যে ১২টি ঘটনায় আধিপত্য বিস্তার ও আর্থিক বিষয় জড়িত। দরপত্র ভাগাভাগি নিয়ে একাধিকবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন। গত ছয় মাস চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও চুয়াডাঙ্গায় অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে খুন হয়েছেন তিনজন।
গত ১১ জুন ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘টাকার জন্য কোনো অপকর্মে যাওয়া যাবে না। টাকার দরকার হলে আমার কাছে আসবে। আমি নেত্রীর সঙ্গে আলোচনা করব।’
বছরের শুরুতে ২১ জানুয়ারি ঢাকা কলেজের আশপাশের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের চাঁদার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এ সময় কলেজ ক্যাম্পাসে থাকা সাতটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তখন কলেজ শাখা আহ্বায়ক নূর আলম ভূঁইয়াসহ ১৯ জনকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ। যদিও মার্চে ওই নূর আলম কেন্দ্রীয় সভাপতির সঙ্গে লক্ষ্মীপুর সফরে যান।
৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর গুলিস্তানে ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদের সময় মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাব্বির হোসেন ও ওয়ারী থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান পিস্তল উঁচু করে গুলি ছোড়েন। ওই ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তাঁদের বহিষ্কার করা হয়।
নেতাদের চাকরি না দেওয়ায় গত ৩ মে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ কে এম নূর-উন-নবীকে ১৪ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ওই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের তিন নেতাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে ছাত্রলীগ।
গত ছয় মাসে চট্টগ্রামে কয়েক দফা নিজেরা নিজেরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে ছাত্রলীগ। বিভিন্ন উন্নয়নকাজের দরপত্রের ভাগ পাওয়া, চাঁদাবাজির কর্তৃত্ব ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণই এসব সংঘর্ষের কারণ বলে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। মাদক ব্যবসায়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গত ১১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের রেয়াজউদ্দিন বাজারে ছাত্রলীগের কর্মী ইয়াছিন আরাফাত প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান। ৪ মে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী নেতা-কর্মীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলায় অন্তত আটজন আহত হন। বিভিন্ন সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ সংঘাত, দরপত্র নিয়ে মারামারি, ছিনতাই, ছাত্রী উত্ত্যক্তসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামে আউটার স্টেডিয়ামে সুইমিংপুল নির্মাণকাজ বন্ধ করতে ভাঙচুরের পর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগ। এতে অন্তত ২৫ জন আহত হন। সর্বশেষ গত বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। একজনকে পিস্তল নিয়ে প্রতিপক্ষকে ধাওয়া করতেও দেখা যায়।
এর বাইরেও ছাত্রলীগের বাধায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বৈঠক পণ্ড, কেরানীগঞ্জে সালিস চলাকালে এক ব্যক্তিকে কোপানো, ঢাকার পুরানা পল্টনে সাংসদের রাজনৈতিক কার্যালয়ে গুলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক হলে কয়েক দফা সংঘর্ষ, পুলিশ কর্মকর্তাকে মারধর, ছিনতাই করতে গিয়ে আটক এবং শিক্ষক লাঞ্ছনার অভিযোগ এসেছে ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সভাপতি গতকাল প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘যারাই অপকর্ম করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমরা কোনো অপরাধকে প্রশ্রয় দিইনি।’