বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে তৈরী পোশাক শিল্প খাত। এ খাতে বিদায়ী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এখন যে হারে অর্ডার মিলছে তাতে সামনের দিনগুলো আরো খারাপ যাবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। তাদের দাবি, এমন বিপর্যয়ের মুখে অতীতে কখনো পড়েনি সম্ভাবনাময় এ শিল্প খাত।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সদ্যবিদায়ী ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে দুই হাজার ৮১৫ কোটি মার্কিন ডলারের তৈরী পোশাক রফতানি করেছে বাংলাদেশ। আগের বছর রফতানি হয় দুই হাজার ৮০৯ কোটি ডলারের পণ্য। অর্থাৎ গত অর্থবছরে তৈরী পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। অথচ তার আগের বছরও (২০১৫-১৬) অর্থবছরও রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ১৪ শতাংশ। ১৫ বছর আগে ২০০১-০২ অর্থবছরের পর আর কখনো এমন বিপর্যয়ে পড়েনি এ খাতটি। সেবার তৈরী পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক। বর্তমানে অর্ডারপ্রাপ্তির যে অবস্থা তাতে এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে সামনের দিনগুলোয় পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিপর্যয়ের বড় অংশ চেপেছে ওভেন পোশাকের ওপর। বিদায়ী বছরে এ উৎস থেকে রফতানি আয় এসেছে এক হাজার ৪৩৯ কোটি ডলার যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ কম। এ সময় নিটওয়্যার খাত থেকে আয় এসেছে এক হাজার ৩৭৫ কোটি ডলার। রফতানি না বাড়লেও পণ্যের দরপতন, বছরে ৮ শতাংশ হারে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং সংস্কারকাজে ব্যাপক খরচের কারণে পোশাক শিল্পে ব্যয় হু হু করে বাড়ছে অথচ সমতা আশঙ্কাজনক হারে কমছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, কোনো কারণে তৈরী পোশাকশিল্প হোঁচট খেলে শ্রমঘন এ শিল্পের সাথে যুক্ত লাখ লাখ শ্রমিক কর্মসংস্থান হারাবে।
রফতানিকারকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের রফতানিতে বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ ভারতের আগ্রাসী নীতি। তৈরী পোশাকের বিশ্ববাজারে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের বাজার দখলে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে প্রতিবেশী দেশটি। প্রণোদনা বাড়ানোর পাশাপাশি তারা পরিকল্পিতভাবে কমিয়েছে রুপির মান। গত পাঁচ বছরে ডলারের বিপরীতে টাকা যেখানে ৪ শতাংশ শক্তিশালী হয়েছে সেখানে ভারতীয় রুপি ৩২ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হওয়ায় আমাদের সমতা কমে গেছে। আবার ডলারের বিপরীতে রুপি দুর্বল হওয়ায় ভারতের সক্ষমতা বেড়েছে। ফলস্বরূপ বাংলাদেশের যেখানে শূন্য দশমিক দুই শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে সেখানে ভারতের অর্জন ১৪ শতাংশের বেশি।
রফতানিকারকদের ৪২টি সংগঠনের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী নয়া দিগন্তকে বলেন, রফতানি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কারণের শেষ নেই। গত এক বছরের আমাদের উৎপাদন খরচ ৮ শতাংশ বেড়েছে। অথচ পণ্যের দাম বাড়েনি, বরং কমেছে। আমাদের প্রতিনিয়ত জ্বালানি সঙ্কটে ভুগতে হচ্ছে। বন্দরে জাহাজ জট লেগেই আছে। সবকিছু ঠিক থাকার পরও আমাদের মাঝেমধ্যেই চার গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে বিমানে পণ্য পাঠাতে হয়। তার ওপর রয়েছে ভাবমূর্তি সঙ্কট। কিছুদিন পরপরই একটা সমস্যা হচ্ছে। বিদেশী বায়াররা স্বাচ্ছন্দ্যে বাংলাদেশে আসতে পারছেন না। সব মিলিয়ে আমাদের সক্ষমতা যে দিন দিন কমছে সে বিষয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই বলে দাবি করেন তিনি।
বিপর্যয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের সরকারের সুসম্পর্কের অভাব, হারানো জিএসপি পুনরুদ্ধারে ব্যর্থতাজনিত ভাবমূর্তি সঙ্কট, ব্রেক্সিটের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ইংল্যান্ডের বেরিয়ে যাওয়া প্রভৃতিকেও দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মেয়াজ্জেম নয়া দিগন্তকে বলেন, সস্তা শ্রমিকের যে সুযোগ আমাদের উদ্যোক্তারা এত দিন পেয়ে আসছিলেন সেটি এখন কমে আসছে। কর্মপরিবেশে কাক্সিত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের তৎপরতায় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু বাড়তি বিনিয়োগ থেকে সুফল তারা নিতে পারছেন না। এ জন্য পণ্যের বহুমুখীকরণে সমস্যা, উৎপাদনশীলতা কাক্সিত পর্যায়ে না যাওয়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিজেদের মধ্যে অসাধু প্রতিযোগিতাকে দায়ী করেন তিনি। ড. মোয়াজ্জেম বলেন, পৃথিবীর সব দেশ যেখানে পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সেখানে, দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের রফতানিকারকেরা ব্যস্ত দাম কমানোর প্রতিযোগিতায়।