মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস গড়ার কর্মসূচি মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোমে (এমএম২ এইচ) অংশগ্রহণের তালিকায় তৃতীয় শীর্ষ অবস্থানে বাংলাদেশিরা। এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৫৪৬ বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়েছেন। এই কর্মসূচির আওতায় ২০০২ সাল থেকে এই বছর পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় বাড়ি বা সেকেন্ড হোম গড়ার অনুমতি পেয়েছেন ১২৬টি দেশের ৩৩ হাজার ৩০০ মানুষ। সূত্র: মালয়েশিয়ার নিউ স্ট্রেইটস টাইমস
যদিও এ জন্য বাংলাদেশ থেকে বৈধ উপায়ে কেউ টাকা নিয়ে যাননি। ফলে সেকেন্ড হোম গড়ার পুরো টাকাই হয়েছে পাচার। তবে এ জন্য কী পরিমাণ অর্থ মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা জানা যায়নি। তবে গড়ে ৮ লাখ টাকা ব্যয় ধরে হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশিরা নিয়ে গেছেন প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এই টাকা কেবল সরকারকে দিতে হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানী কুয়ালালামপুরে এমএম২ এইচ নিয়ে জাতীয় কর্মশালায় দেশটির পর্যটন ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী নাজরি আজিজ এ তথ্য জানিয়েছেন। দেশটির কর্তৃপক্ষ জানায়, এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে চীন। দেশটির ৮ হাজার ৭১৪ ব্যক্তি মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করেছেন। এরপরের অবস্থানে আছে জাপান (৪ হাজার ২২৫ জন)। তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, প্রচলিত নিয়মে দেশ থেকে সেকেন্ড হোম করার জন্য অর্থ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দেশের অর্থ পাচারের ঘটনা তদন্ত করে থাকে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। তারা বলছে, গত বছর অর্থ পাচারের ৩২টি ঘটনা ধরা পড়েছে এ ইউনিটের তদন্তে, যার মধ্যে মালয়েশিয়ায় অর্থ পাচারের ঘটনাও আছে। বিচারের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠানো হয়েছে এসব প্রতিবেদন।
জানতে চাইলে বিএফআইইউর উপপ্রধান দেবপ্রসাদ দেবনাথ বলেন, ‘মালয়েশিয়ার কাছে তথ্য চাইলেই পাওয়া যায় না। কী কারণে, কার
সম্পর্কে তথ্য প্রয়োজন, বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে তথ্য চাইতে হয়। আমাদের জালে বেশ কিছু অর্থ পাচারের ঘটনা ধরা পড়ছে। দুদকে এসব পাঠানো হয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, যারা মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করেছে, সবাই টাকা পাচার করেছে। দেশ থেকে তো কেউ অনুমোদন নিয়ে সেখানে আবাস গড়েনি। এতেই প্রমাণিত হচ্ছে, দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো টাকা পাচার ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে।
ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেন, কারা আবাস গড়ল, বাংলাদেশের হাইকমিশন তাদের তালিকা বের করতে পারে। এরপর দেশের সংস্থাগুলো তাদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনতে পারে। তাহলে পরবর্তী সময়ে টাকা পাচারের প্রবণতা কমে আসবে। বাংলাদেশ সরকারের এ সদিচ্ছা আছে বলে মনে হয় না। কারণ, যারা আবাস গড়েছে, সবাই প্রভাবশালী।
মালয়েশিয়ার পর্যটনমন্ত্রী নাজরি আজিজ বলেন, যুক্তরাজ্য থেকে ২ হাজার ৪১২ জন, ইরান থেকে ১ হাজার ৩৩৬ জন, সিঙ্গাপুর থেকে ১ হাজার ২৯৫ জন, তাইওয়ান থেকে ১ হাজার ২০৮ জন, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১ হাজার ২৬৬ জন, পাকিস্তান থেকে ৯৭৩ জন এবং ভারত থেকে ৮৯০ জন এই কর্মসূচির সুবিধা নিয়েছেন। নাজরি বলেন, সেকেন্ড হোম কর্মসূচির সুবিধা থেকে স্থাবর সুবিধা ও রাজস্ব হিসেবে মোট ১ হাজার ২৮০ কোটি মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ হয়েছে।
পর্যটনমন্ত্রী বলেন, এ লক্ষ্যে মালয়েশিয়ার প্রবেশের জন্য ভিসা দেওয়া বাবদ ৫ কোটি ২০ লাখ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত আয় হয়েছে। এ ছাড়া ফিক্সড ডিপোজিট (স্থায়ী আমানত) হয়েছে ৪৯০ কোটি রিঙ্গিত। গাড়ি কেনা বাবদ আয় ১৪ কোটি ৮০ লাখ রিঙ্গিত। স্থাবর সম্পত্তি কেনা বাবদ আয় ৪৯০ কোটি রিঙ্গিত। তিনি বলেন, এই সুবিধা নেওয়া ব্যক্তিদের মাসিক হাতখরচ প্রায় ১০ হাজার রিঙ্গিত করে। তবে বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের কাছে বন্ধুদের বেড়াতে আসা, খাবারদাবার এবং কেনাকাটা এর মধ্যে হিসাব করা হয়নি।
২০০২ সালে এই কর্মসূচি চালুর পরের বছর অর্থাৎ ২০০৩ সাল থেকে এই কর্মসূচিতে আবেদন করেন বাংলাদেশিরা। প্রথম বছর ৩২ জন বাংলাদেশি ওই সুবিধা পান। মালয়েশিয়ার সাবেক হাইকমিশনার নরলিন ওথম্যান ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ওই সময় পর্যন্ত কর্মসূচির আওতায় ২ হাজার ৯২৩ জন বাংলাদেশি সেখানে দীর্ঘ মেয়াদে বসবাসের সুবিধা পেয়েছেন। শুধু ২০১৪ সালেই আবেদন করেন ২৮৫ জন। বাংলাদেশের কোনো রাজনীতিক এ সুবিধা নিয়েছেন কি না, প্রশ্ন করলে মুচকি হেসেছিলেন তিনি।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে ২০১৪ সালে প্রায় ৯১১ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। আমদানি-রপ্তানির সময়ে পণ্যের প্রকৃত মূল্য গোপন করার মাধ্যমেই এই অর্থের বড় অংশ পাচার করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
সুযোগ পাওয়ার আর্থিক যোগ্যতা ও ফি
এমএম২ এইচের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস কর্মসূচির আবেদন করার আগে ন্যূনতম কিছু আর্থিক শর্ত পূরণের বিধান রয়েছে। পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের সাড়ে ৩ লাখ নগদ এবং দেড় লাখ মালয়েশীয় রিঙ্গিতের স্থায়ী আমানত থাকতে হবে। ওই বয়সের লোকজনের মাসিক আয় হতে হবে ১০ হাজার মালয়েশীয় রিঙ্গিত। ৫০ বছরের নিচে এই হার যথাক্রমে ৫ লাখ, ৩ লাখ ও ১০ হাজার মালয়েশীয় রিঙ্গিত। পঞ্চাশোর্ধ্ব সরকারি অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জন্য স্থায়ী আমানতের কোনো বিধান নেই। তবে এই শ্রেণির লোকজনের নগদ সাড়ে ৩ লাখ এবং মাসে ১০ হাজার মালয়েশীয় রিঙ্গিত আয় করতে হবে। পঞ্চাশোর্ধ্ব বা পঞ্চাশের নিচে যাঁদের ১০ লাখ মালয়েশীয় রিঙ্গিত সমমূল্যের বাড়ি থাকবে, তাঁদের ক্ষেত্রে কিছু ছাড় আছে। পঞ্চাশের নিচের বয়সীদের সাড়ে ৩ লাখ এবং স্থায়ী আমানত দেড় লাখ থাকলেই চলবে। তবে তাঁদের মাসিক আয় ১০ হাজার মালয়েশীয় রিঙ্গিত হতে হবে। আর পঞ্চাশোর্ধ্ব নগদ সাড়ে ৩ লাখ এবং ১ লাখ মালয়েশীয় রিঙ্গিত স্থায়ী আমানত থাকতে হবে। তাঁদের ক্ষেত্রে মাসিক আয় ১০ হাজার মালয়েশীয় রিঙ্গিত হতে হবে। তবে প্রার্থীর আবেদন প্রাথমিকভাবে অনুমোদনের নির্ধারিত সময়ের পর তাঁরা স্থায়ী আমানতের একাংশ তুলে নিতে পারবেন।
এই সুবিধা পেতে হলে একজন ব্যক্তিকে ৭ হাজার, স্বামী-স্ত্রীর জন্য সাড়ে ৭ হাজার এবং একটি পরিবারের জন্য ৮ হাজার মালয়েশীয় রিঙ্গিত ফি দিতে হয়। এখানে বলে রাখা ভালো, পরিবার বলতে স্বামী ও স্ত্রী ছাড়া তাঁদের দুজনের সন্তানকে নিয়ে একটি পরিবার বিবেচনা করা হয়। পরিবারের সদস্য এর চেয়ে বেশি হলে প্রতিটি সন্তানের জন্য বাড়তি আড়াই শ মালয়েশীয় রিঙ্গিত ফি দিতে হয়।