লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি

Slider জাতীয়

73679_lead

 

 

 

 

উজান থেকে ধেয়ে আসা পাহাড়ি ঢল আর প্রবল বৃষ্টিপাতে বাড়ছে দেশের প্রধান নদনদীর পানি। বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। সর্বশেষ ভারত থেকে নেমে আসা পানির তোড়ে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলার নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পানিবন্দি মানুষ ত্রাণের অপেক্ষায় আছেন অনেক এলাকায়। পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বন্যার কারণে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় পশুখাদ্যেরও সংকট দেখা দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র গতকাল জানিয়েছে, উত্তরাঞ্চলের ৯টি নদনদীর ১৩টা পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সোমবার যমুনা নদীর বাহাদুরাবাদ স্টেশনে পানি স্থিতিশীল অবস্থায় থাকলেও মঙ্গলবার সেখানে বিপদসীমার ৬৪ সে.মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। একই নদীর সারিয়াকান্দি স্টেশনে সোমবার পানি নিম্নমুখী থাকলেও মঙ্গলবার ৪০ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়া সোমবার থেকে বিপদসীমা অতিক্রমকারী সবগুলো স্টেশনের পানি মঙ্গলবার প্রায় ২০ থেকে ২৫ সে.মি. বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন করে কয়েকটি স্টেশনে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। ধরলা, তিস্তা, ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ধলেশ্বরী, সুরমা, কুশিয়ারা, কংশ, গঙ্গা ও পদ্মা নদীর পানি আগামী ২৪ ঘণ্টায় বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রে ‘বৃষ্টিপাত ও নদনদীর অবস্থার রিপোর্টে বলা হয়, সোমবার সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত বরগুনা স্টেশনে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১১০ মিলিমিটার। ভাগ্যকূল স্টেশনে ১০৬ মিলিমিটার, ডালিয়া স্টেশনে ৮২ মিলিমিটার, নোয়াখালী ৭৫ দশমিক ৫ মিলিমিটার। রোববার পর্যন্ত ৫৫টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেও সোমবার নাগাদ ৭০টি নদনদীর পানি বেড়েছে। আবহাওয়া অফিস জানায়, মৌসুমী বায়ুর কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাঝারি থেকে ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে।
ত্রাণের আশায় বানভাসী লাখো মানুষ
প্রতীক ওমর, বগুড়া থেকে জানান, বগুড়াসহ উত্তরের জেলাগুলোতে গত চব্বিশ ঘণ্টা টানা বৃষ্টি এবং উজানের পাহাড়ি ঢল এবং ভারত তিস্তা ব্যারেজের সবগুলো গেইট খুলে দেয়ায় যমুনা নদীর পানি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ফলে বগুড়া, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম জেলায় বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। অনেক এলাকায় এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি। বিশুদ্ধ পানি, জ্বালানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। বেড়েছে পানিবাহিত নানা ধরনের রোগ-ব্যাধি। বন্যার পানি স্কুলে প্রবেশ করায় বগুড়ায় ৭০, গাইবান্ধায় ৫১ সহ গোটা উত্তরাঞ্চলে আড়াই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ আছে। এসব এলাকায় মানুষের পাশাপাশি লাখ লাখ গবাদিপশু ও খাদ্য সংকটে পড়েছে। পানির নিচে নষ্ট হওয়ার পথে বিভিন্ন সফল।
এদিকে চব্বিশ ঘণ্টায় বগুড়ায় বৃষ্টি রেকর্ড হয় ৪৪.২ সেন্টিমিটার। ফলে সোমবার সন্ধ্যা ৬ টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬ টা পর্যন্ত ১৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে সারিয়াকান্দি ও ধুনট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৩৮ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে সারিয়াকান্দি, ধুনট এবং সোনাতলা উপজেলার দশ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
বগুড়ার বন্যা দুর্গত ইউনিয়নগুলো হচ্ছে সারিয়াকান্দি উপজেলার কুতুবপুর, কামালপুর, চন্দনবাইশা ও কর্ণিবাড়ী, সোনাতলা উপজেলার মধুপুর, তেকানি চুকাইনগর, পাকুল্লা, ধুনটের ভাণ্ডারবাড়ী, গোসাইবাড়ী ইউনিয়ন। তিন উপজেলার এসব ইউনিয়নগুলোর দশ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নতুন করে  নিম্নাঞ্চলগুলোর লোকালায়ে পানি প্রবেশ করছে। এতে গৃহহারার সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।  ঘরে পানি প্রবেশের কারণে দুর্গত পরিবারগুলো বাঁধের উঁচু স্থানে আশ্রয়ের জন্য ছুটছে বন্যার্তরা। এদিকে লোকালয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করার কারণে বিশুদ্ধপানি, খাবার এবং তীব্র জ্বালানি সংকটে পড়েছে বন্যার্তরা।
সারিয়াকান্দি উপজেলার ধলিরকান্দি পুরাতন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নেয়া সাহেব আলী (৬২), আসাদ প্রামাণিক (৬৪), মনেজা বেগম (৫০), গোলাপী বেগম (৭০)  জানান, তাদের থাকার ঘরে এখন কোমরপানি। টিউবওয়েল পুরোটাই পানির নিচে। ঘরের পালিত ৪টি গরু ৮টা ছাগল নিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে তারা। নিজেদের পাশাপাশি গবাদিপশুর খাদ্য সংকট তাদের চিন্তিত করে তুলেছে। তারা অভিযোগ করেন কোন ত্রাণ এখন পর্যন্ত তাদের হাতে পৌঁছেনি।
এদিকে বন্যাদুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা ধরনের রোগ। এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা বেশি। খাবার স্যালাইন এবং বিশুদ্ধ পানি সংকট এসব বন্যার্তদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে।
অপরদিকে তিন উপজেলায় বিভিন্ন ফসলি জমি পানির নিচে ডুবে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে ২০ হাজার ৫০ কৃষক পরিবার। বন্যার পানির নিচে ডুবে গেছে রোপা আমন, আউশ, বীজতলা, পাট, মরিচ এবং শাক-সবজির ক্ষেত। কৃষি অফিসের তথ্যমতে সারিয়াকান্দি ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর, সোনাতলা ৮২৫ হেক্টর, ধুনট ১৯০ হেক্টর, উপজেলায়  তিন উপজেলার ২০ হাজার ৫০ কৃষকের ৪ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমির ফসল বর্তমানে পানি নিচে ডুবে গেছে। এতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কৃষি অফিসের মতে পানি দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করলে ডুবে যাওয়া জমির  ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে। বিশেষ করে এসব এলাকায় চাষকৃত পাট পানির নিচে পচে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় সময়ের অনেক আগেই বাধ্য হয়ে কাটছে কৃষকরা। এতে এবারের পাটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে। কাঁচা মরিচসহ সবজির সংকটও প্রকট আকার ধারণ করতে পারে বলে  আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কৃষকরা।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক প্রতুল চন্দ্র সাহা জানান, বন্যাকবলিত তিন উপজেলার ফসলের ক্ষতির পরিমাণ কত হবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না। তিনি জানান, পানি কত দিন অবস্থান করবে তার উপর নির্ভর করবে ক্ষতির পরিমাণ। কৃষি অফিস বন্যাদুর্গত এলাকায় কৃষকদের এখন কি করনীয় সে বিষয়ে পরমার্শ দিয়ে যাচ্ছে।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রুহুল আমিন জানান, যমুনার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলেও বাঁধ যাতে ভেঙে না যায় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়েছে।
গাইবান্ধায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি
উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি মঙ্গলবার আরও অবনতি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্যানুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি ১১ সে.মি. বৃদ্ধি পেয়ে এখন বিপদসীমার ৩৮ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এসময় ঘাঘট নদীর পানি ১৬ সে.মি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২৪ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া তিস্তা, যমুনা ও করতোয়া নদীর পানি এখন বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে।
ইতোমধ্যে ফুলছড়ি উপজেলার ৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ চরাঞ্চল বেষ্টিত ৫১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশপাশে বন্যার পানি উঠায় পাঠদান বিঘ্নিত হচ্ছে।
অপরদিকে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় জেলার সুন্দরগঞ্জ, সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার নতুন নতুন এলাকা পাবিত হয়েছে। ৪ উপজেলার প্রায় ৭৫ হাজার পরিবার এখন পানিবন্দি। ওইসব এলাকার নিম্ন ও চরাঞ্চলের রাস্তা-ঘাট, ফসলী জমি জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। দ্রুত পানি বৃদ্ধির কারণে নদী তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের মানুষরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এদিকে পানির তোড়ে সদর উপজেলার কামারজানি বন্দরের দক্ষিণ দিকে ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ২০টি ঘরবাড়ি সরিয়ে নিতে হয়েছে। এছাড়া শ্রীপুর ও কামারজানির সীমান্তে সরাইল রেগুলেটরটি ভাঙনের মুখে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড রেগুলেটরটি রক্ষায় ভাঙন এলাকায় বালিভর্তি জিও ব্যাগ ব্রহ্মপুত্রের তীরে নিক্ষেপ করছে।
এ পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জরুরিভাবে ১শ’ ২৫ মে. টন চাল ও ১০ লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে বিতরণ করা হয়েছ ৫০ মে. টন চাল ও ২ লাখ টাকা।
সিরাজগঞ্জে প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চল
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সিরাজগঞ্জের ৫ উপজেলার চরাঞ্চলের ২৮টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি ১৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৪৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্রতিদিনই জেলার নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলসহ সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার বেশ কিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। অপরদিকে, পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চৌহালী উপজেলার এনায়েতপুরের আরকান্দি থেকে শাহজাদপুরের কৈজুরী পর্যন্ত এলাকায় নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। ডুবে গেছে এসব অঞ্চলের শত শত একর ফসলি জমি।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম জানান, মঙ্গলবার যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ১৮ সেন্টিমিটার বেড়ে ৪৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানি আরও বৃদ্ধির আশংকা রয়েছে। কাজিপুরের মাছুয়াকান্দিতে ক্রসবার বাঁধের স্যাংক ভেঙে গেলেও সেখানে জরুরি ভিত্তিতে জিওব্যাগ বালির বস্তা নিক্ষেপের জন্য বরাদ্দ তো দূরের কথা, এখনও বোর্ড থেকে অনুমতিই পাইনি। সদর উপজেলার বাহুকা নামক স্থানেও থেমে থেমে পাড় ভাঙছে। যমুনার পানি বাড়লেই ভাড়ন বাড়ে।  প্রবল স্রোতের কারণে নদীতীরের চৌহালী উপজেলার এনায়েতপুরের আরকান্দি থেকে শাহজাদপুরের কৈজুরী পর্যন্ত এলাকায় নদীভাঙন শুরু হলেও সেখানে বাঁধ না থাকায় কোনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।
সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক কামরুন্নাহার সিদ্দীকা জানান, এখনও সিরাজগঞ্জ জেলায় বন্যা ভয়াবহ অবস্থায় রূপ নেয়নি। এখনও অবস্থা আমাদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সার্বিক খোঁজ-খবর রাখার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমি নিজেও এরই মধ্যে চৌহালী, বেলকুচি, সদর ও কাজিপুরের বন্যা ও ভাঙন এলাকা সরজমিনে পরিদর্শন করেছি। ত্রাণ বিতরণও শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে সদরের সয়দাবাদ ও কাজিপুরের শুভগাছায় ৫ শতাধিক পরিবারকে ক্ষয়রাতি ১০ কেজি করে চাল ও নগদ দু’শ’ টাকা করে সহায়তা দেয়া হয়েছে। দুর্গতদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ মজুত রয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বন্যা কবলিত উপজেলাগুলোতেও ত্রাণ সহায়তা দেয়া হবে।
সিরাজগঞ্জ জেলা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আরশেদ আলী বলেন, জেলার বন্যা উপদ্রুত এলাকায় প্লাবিত কৃষি জমির তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে। মাঠপর্যায় থেকে এখনও প্রকৃত হিসাব তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়নি।
সিরাজগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুর রহিম জানান, সরকারি হিসাবে চরাঞ্চলের ২ হাজার পরিবারের ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। নতুন করে আরও যে সকল এলাকা প্লাবিত হচ্ছে সেই সব এলাকার তালিকা চেয়ে পাঠানো হয়েছে।
লালমনিরহাটে ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি
লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা, ধরলা, বুড়ি তিস্তা ও সানিয়াজান নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় লালমনিরহাটে আবারও বন্যা দেখা দিয়েছে। নদীগুলোর পানি বৃদ্ধির কারণে জেলার তিস্তা তীরবর্তী এলাকাগুলোতে এ বন্যা দেখা দেয়। তিস্তার পানিতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে। সোমবার সকাল থেকে আবারও নদীগুলোর পানি বাড়তে শুরু করে। হাতীবান্ধা উপজেলার উত্তর ধুবনী গ্রামে সোমবার সকালে একটি বাঁধ ভেঙে গেছে। দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের দোয়ানী পয়েন্টে সোমবার সকালে বিপদ সীমার ৩২ সে.মি. উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হতে থাকে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ব্যারেজের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে পানি আসায় তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ তৃতীয় দফায় বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে তিস্তার তীরবর্তী এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। আমরা প্রতি মুহূর্তে বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিং করছি। তিস্তার পানি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। আরও কি পরিমাণ পানি আসবে তা ধারণা করা যাচ্ছে না। ফলে ব্যারেজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
তিস্তা পাড়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক দিন আগের বন্যায় চর এলাকাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। জেলার হাতীবান্ধা উপজেলায় বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। ওই উপজেলার উওর ধুবনী গ্রামে বাঁধ ভেঙে গেছে। যে কারণে ওই এলাকায় বেশকিছু পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি লোকজনের মাঝে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। ভারত গজল ডোবা ব্যারেজের অধিকাংশ গেট খুলে দেয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই ঘর বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। প্রচণ্ড গতিতে ময়লা ও ঘোলা পানি বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে। পানি গতি নিয়ন্ত্রণ করতে তিস্তা ব্যারাজের সবক’টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে। ফলে তিস্তার পানিতে পাটগ্রামে অবস্থিত বহুল আলোচিত বিলুপ্ত ছিটমহল আঙ্গরপোঁতা-দহগ্রাম, হাতীবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিঙ্গিমারী, সির্ন্দুনা, পাটিকাপাড়া ও ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়ন, কালীগঞ্চ উপজেলার ভোটমারী, শোলমারী, জমিরবাড়ী, বইরাতী, আদিতমারী উপজেলার কুঠিপাড়া, গোবর্ধন, সদর উপজেলার খুনিয়াগাছা, রাজপুর, তিস্তা, গোকুণ্ড এলাকার চরে ১৮ গ্রামের ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। হাজার হাজার একর আমন ধানের বীজ তলাসহ অনেক ফসলী ক্ষেত তিস্তার পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
হাতীবান্ধা উপজেলার দক্ষিণ ধুবনী গ্রামের শামসুল হক, শরীফ মোল্লা, আব্দুস ছালাম, আবুল কাশেম, নুরল হকসহ অনেক পানিবন্দি পরিবার অভিযোগ করেন, আমরা কয়েকদিন ধরে পানিবন্দি অবস্থায় আছি। এখন পর্যন্ত আমাদের মাঝে কোন ত্রাণ বিতরণ করা হয়নি। কেউ আমাদের খোঁজ পর্যন্ত করেনি।
হাতীবান্ধা উপজেলার সিঙ্গিমারী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন দুলু জানান, তার ইউনিয়নের উওর ধুবনী গ্রামে একটি বাঁধ ভেঙে গেছে ফলে বেশ কিছু পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তিনি ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যদের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তালিকা তৈরি করছেন। ইতোমধ্যে ত্রাণের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট আবেদন করেছেন।
হাতীবান্ধা উপজেলার সির্ন্দুনা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নুরুল আমিন জানান, তার ইউনিয়নে ১২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তিনি ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
হাতীবান্ধা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ফেরদৌস আহম্মেদ জানান, ইতিমধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে পানিবন্দি পরিবারগুলোর খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে উচ্চপর্যায়ে প্রেরণ করা হবে। ত্রাণের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করা হয়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবুল ফয়েজ মো. আলা উদ্দিন খান জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে পানিবন্দি পরিবারগুলোর খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। ত্রাণের জন্য উচ্চ পার্যায়ে আবেদন করা হয়েছে।
রাজারহাটে নদীগর্ভে বিলীন ৩০০ ঘর-বাড়ি
রাজারহাট (কুড়িগ্রাম) প্রতিনধি জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও প্রবল বৃষ্টিতে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে প্রবল স্রোতে গত ৩ দিনের তীব্র ভাঙনে উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের তৈয়বখাঁ এলাকায় প্রায় ৩০০ ঘর-বাড়ি, গাছপাল, সুপারি বাগান ও কয়েক একর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পানিবন্দি ও বাসু্তহারা পরিবারগুলো বাঁধে এবং অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। এ ছাড়াও ঘরে পানি উঠায় অনেকে মাচাং করে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। এদিকে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন ঠেকাতে পাইলিংয়ের কাজ শুরু করেছে।
বাস্তুহারা পরিবার ও এলাকাবাসীরা জানান, তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি হু-হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা ও ধরলা নদীর সবক’টি চরাঞ্চল ডুবে গেছে। এর ফলে আমন বীজতলা ও শতাধিক পুকুর ডুবে গিয়ে কোটি টাকার মাছ ভেসে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া  চরের শ’ শ’ মানুষ, গবাদী পশু পানিবন্দি হয়ে পড়ে। ডুবে যাওয়া চরের মানুষজন মানবেতর জীবন-যাপন করছে। চর তৈয়ব খাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর বিদ্যানন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ছিনাই কিং আবুল হোসেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে পানিবন্দি হওয়ায় ওই তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রফিকুল ইসলাম ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবুল হাসেম বন্যাকবলিত এলাকা সমূহ পরিদর্শনের সময় বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের ৮৬টি পরিবার ও ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের ২১টি পরিবারের মাঝে ৩০ কেজি করে চাল এবং ১৫টি পরিবারের মাঝে নগদ ২০০০ টাকা করে ত্রাণ বিতরণ করেন। এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান বলেন, যে কোনো ধরণের দুর্যোগ মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে। বন্যাকবলিতদের মাঝে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাল ও নগদ অর্থ বিতরণ করা হচ্ছে। ভাঙনরোধকল্পে ব্যবস্থা গ্রহণে পাউবো’র কর্মকর্তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করা হচ্ছে এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাসমূহ পরিদর্শনপূর্বক ত্রাণ সহায়তা প্রদান করছি।
চিলমারীতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত
চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, কুড়িগ্রামের চিলমারীতে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত। নতুন করে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে আরো ৫ হাজার পরিবার। এই নিয়ে উপজেলার ৬ ইউনিয়নে পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার।
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি এখন চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ২৬ সে.মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ১৭ সে.মিটার। শুরু হয়েছে তীব্র নদীভাঙন। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। চিলমারী, নয়ারহাট ও অষ্টমীরচর ইউনিয়নের সব ক’টি গ্রাম বন্যা প্লাবিত হয়েছে। এদিকে রমনা ইউনিয়নের ব্যাংকমারা, সোনারীপাড়া, রমনা খামার, বাসন্তিগ্রাম, মাঝিপাড়া, ভরট্টপাড়া, খেউনীপাড়া, পাত্রখাতা, থানাহাট ইউনিয়নের রাজারভিটা, পুঁটিমারী, মাচাবান্ধা, রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের নয়াবস, মজারটারী, চর বড়ভিটা গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যার্ত লোকজন স্কুলসহ, রাস্ত এবং উচুঁ স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। ১৯টি সরকারী প্রথমিক বিদ্যালয়ে পানি ঢুকে পড়ায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এদিকে সরকারীভাবে মঙ্গলবার ৬টি ইউনিয়নে ১ হাজার ৫শ’ জনের মাঝে জনপ্রতি ১০ কেজি করে মোট ১৫ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মির্জা মুরাদ হাসান বেগ জানিয়েছেন দ্বিতীয় দফায় ২০ মেট্রিক চাল ও নগদ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণ সামগ্রী অপ্রতুল বলে দাবী করছেন ইউপি চেয়ারম্যানগণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *