নানা উদ্যোগও পোশাক খাতে মৃত্যু থামাতে পারছে না

Slider জাতীয়

 

base_1499543277-1

 

 

 

 

 

২০১৩ সালে সাভারে ঘটে যাওয়া রানা প্লাজা ধসকে শিল্পের ইতিহাসে অন্যতম বড় বিপর্যয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৪ জন পোশাক শ্রমিক। এমন দুর্ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সেজন্য বাংলাদেশের পোশাক শিল্প-কারখানার নিরাপত্তা মূল্যায়নে নেয়া হয় স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নানা উদ্যোগ। কিন্তু এসব উদ্যোগও শ্রমিকের মৃত্যু থামাতে পারেনি। ২০১৩ সালের পরও গত তিন বছরে প্রায় ৩০০ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। সর্বশেষ গত ৩ জুলাই গাজীপুরের নিট পোশাক কারখানা মাল্টিফ্যাবস লিমিটেডে প্রাণ হারিয়েছেন ১৩ জন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিআইএলএস) সমীক্ষা অনুযায়ী, পোশাক শিল্পে এ ধরনের দুর্ঘটনায় গত পাঁচ বছরে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৪২৯ জন। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১২ সালে পোশাক শিল্পের কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনায় নিহত হন ১৫৫ জন শ্রমিক। এর মধ্যে তোবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশন্সের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১১০ জনের বেশি নিহত হন। এর পরের বছর ২০১৩ সালে পোশাক শিল্পে নিহত হন মোট ১ হাজার ১৯৪ জন। এর মধ্যে শুধু রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় নিহত হন ১ হাজার ১৩৪ জন।

বিআইএলএসের হিসাবে ২০১৪ সালে পোশাক শ্রমিক নিহত হন ৫০ জন। ওই বছরের উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনার মধ্যে রয়েছে কালিয়াকৈরে ঊর্মি নিটওয়্যারে অজ্ঞাত কারণে দুই ইটিপি অপারেটরের মৃত্যু। এর পর বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে  প্রাণহানির ঘটনা ঘটে ফতুল্লাহর আমেনা ডায়িংয়ে। ২০১২ সালে অগ্নিকাণ্ডে আহত শ্রমিক আমেনা বেগম চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান ২০১৪ সালে।

বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ২০১৫ সালে নিহত হন ২১ জন পোশাক শ্রমিক এবং ২০১৬ সালে নয়জন। ২০১৬ সালে পোশাক শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, এমন কারখানার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পদ্মা পলি-কটন নিট অ্যান্ড ফ্যাব্রিকস লিমিটেড। এ কারখানার দুজন শ্রমিক ওয়াশিং মেশিনে দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে মারা যান।

বিআইএলএসের ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত পরিসংখ্যানের পুঞ্জীভূত হিসাব অনুযায়ী, গত ৫ বছরে দেশে মোট পোশাক শ্রমিক নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৪২৯ জন। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটেছে ৩ জুলাই। মাল্টিফ্যাবস লিমিটেডে বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় শ্রমিক নিহত হয়েছেন ১৩ জন। এ সংখ্যা হিসাব করলে সাড়ে পাঁচ বছরে কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৪৪২ জন।

পোশাক শিল্পে ধারাবাহিক মৃত্যুর ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শ্রমিক প্রতিনিধিরা বলেন, পোশাক শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনাগুলো শ্রমিক শোষণের সবচেয়ে নির্মম বাস্তবতা। বিশ্বের ভয়াবহতম কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনা বাংলাদেশের ঘটলেও মালিকরা এখনো অসতর্ক। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমাজের সকল ক্ষেত্রে উন্নয়ন না ঘটায় শিল্প নিরাপত্তায় ফাঁকফোকর থেকেই যাচ্ছে। পরিপ্রেক্ষিতে কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনায় নিহতের ঘটনা থামানো সম্ভব হচ্ছে না।

বিআইএলএসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, কথা বলে মৃত্যু কমানো যাবে না। মৃত্যু কমাতে হলে সর্বাত্মক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, সেটা অনুপস্থিত। এখন পর্যন্ত যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো আংশিক। অ্যাকর্ড ৩ জুলাইয়ের ঘটনার পরে বলছে, বয়লার মূল্যায়নের আওতায় ছিল না। প্রশ্ন জাগে, নিরাপত্তা আবার আংশিক হয় কী করে? এটি একটি নির্মম রসিকতাই মনে হয়েছে আমার কাছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে সামগ্রিক এবং সমন্বিত উদ্যোগটিই প্রথম অগ্রাধিকার পাওয়ার মতো পদক্ষেপ মন্তব্য করে তিনি  বলেন, দুর্ঘটনায় মৃত্যু যেমন থামেনি, তেমনি কোনো ঘটনার বিচারও হয়নি। অপরাধের যদি কোনো বিচার না হয়, শাস্তি না হয়, তদন্ত রিপোর্ট কেউ না জানে, অপরাধী ঘুরে বেড়ায়— তাহলে কি দাঁড়াল? আবার অপরাধী কিনা, সেটা জানারও সুযোগ হয় না। বিচারহীনতা ও দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়ার একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে শিল্পে, যার ফলশ্রুতিতে সতর্ক হওয়া থেকে বিরত থাকা সম্ভব হচ্ছে। দায় এড়ানোর মনোভাব কাটিয়ে উঠতে হবে। রাষ্ট্র যদি উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রশাসনিক, সামাজিক উন্নয়ন না ঘটায় তাহলে তো ফাঁকফোকর থেকেই যাবে।

শ্রমিক প্রতিনিধিদের দাবি, শ্রমিক নিহতের ঘটনায় ক্ষতিপূরণের পরিমাণ অনেক কম আবার এ সম্পর্কিত প্রতিবাদ প্রতিরোধও কম। একটি ঘটনা ঘটলে কিছু কর্মসূচি নেয়া হয়। কিন্তু ধারাবাহিকতা নেই। রানা প্লাজার পর তো সকল পক্ষের সমন্বিত সচেতনতার প্রতিফলন দেখা যাওয়ার কথা। কিন্তু তা দেখা যাচ্ছে না। কাজেই সক্রিয়তা ও সোচ্চার হওয়ার বিষয়টিতেও ঘাটতি আছে। সব মিলিয়ে মালিকপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর দায় এড়ানোর মানসিকতা দুর্ঘটনা কমানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দেখা দিচ্ছে।

এ বিষয়ে পোশাক শিল্প মালিক প্রতিনিধি সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দুিকর রহমান বলেন, দুর্ঘটনা আগের চেয়ে কমেছে। রানা প্লাজার পর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি বললেই চলে। সর্বশেষ যেটি ঘটেছে সেটিও মূলত ডায়িং কারখানার বয়লার। এটি অপারেট করার ক্ষেত্রে অপারেটরের ভুল ছিল বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে যার ভুলেই হোক এ ধরনের মৃত্যু কখনই কাম্য নয়। আর এজন্য দায় শুধু একা মালিকের না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *