‘ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট’- শুধু ক্রিকেট নয়, ফুটবল, হকিসহ সব খেলাধুলার সবচেয়ে সহজ অথচ কঠিন সত্য এটি। আবার জীবনের বাস্তবতায় সবচেয়ে কঠিন সত্য হচ্ছে- ‘সবকিছুকেই জয় করা সম্ভব। শুধু বয়সকে জয় করা সম্ভব নয়’। বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম প্রতিভাবান, সবচেয়ে সফল ওয়ানডে অধিনায়ক এবং ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম লড়াকু ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজার সঙ্গে বেশ মানিয়ে যায় বিশেষণ দুটি। প্রায় ১৬ বছর বাংলাদেশ ক্রিকেটকে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। রয়েছেন দারুণ ফর্মে। তারপরও তার ক্রিকেট ভবিষ্যৎ এখন সংশয়ের সুতায় ঝুলছে। মাশরাফির ওয়ানডে অধিনায়কত্ব নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে বিসিবি। এক্ষেত্রে বিসিবিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মাশরাফির বয়স। টাইগার অধিনায়কের বয়স এখন ৩৪ ছুঁই ছুঁই। ২০১৯ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে তার বয়স হবে ৩৬। মাশরাফির নেতৃত্বে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলবে কি না- এ নিয়ে এখন ক্রিকেট মাঠ বেজায় গরম। পক্ষে-বিপক্ষে জোর আলোচনা। এমন পরিস্থিতিতে ক্রিকেটার, বোর্ড পরিচালক, নির্বাচকরা কেউই কিছু বলতে চাইছেন না সরাসরি। বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম সফল ব্যাটসম্যান ও নির্বাচক প্যানেলের অন্যতম সদস্য কাজী হাবিবুল বাশারও মাশরাফির নেতৃত্ব পরিবর্তন নিয়ে কিছু না বলে শুধু জানিয়েছেন, দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেটার মাশরাফি।
৫-৬ দিন আগে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন মিডিয়ার মুখোমুখিতে সরাসরি মাশরাফির ওয়ানডে অধিনায়কত্ব নিয়ে কিছু বলেননি। টি-২০ ক্রিকেটে তার নেতৃত্ব ছাড়ার পর ২০১৯ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের বিষয়টিও প্রসেসিংয়ের মধ্যে রয়েছে বলে জানান। বিসিবি সভাপতির ওই বক্তব্যের পর থেকেই ক্রিকেট মাঠ গরম। বিসিবি পরিচালক ও সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান জানিয়েছেন, বিষয়টি মাশরাফির নিজের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত। বাশার বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাইছি না। ’ কিছু না বললেও মাশরাফিকে অন্য যে কারও চেয়ে একটু বেশিই চেনেন এবং জানেন। কারণ তার নেতৃত্বেই মাশরাফি বহু ম্যাচে জয় উপহার দিয়েছেন দেশকে। তাই ভালো করেই জানেন মাশরাফির গুণগুলো, ‘আমরা একসঙ্গে অনেক বছর ক্রিকেট খেলেছি। ঘরোয়া ক্রিকেটের বাইরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই বেশি খেলেছি। প্রথম থেকেই আমার লড়াকু মনে হয়েছে। শেষ বল পর্যন্ত লড়াই করার তীব্র মানসিকতাই তাকে আজকের মাশরাফিতে পরিণত করেছে। ’ শুধু লড়াকু মানসিকতাই নয়, ব্যক্তি মানুষ হিসেবেও মাশরাফি অনেক বড় মনের বলেন সাবেক অধিনায়ক, ‘জাতীয় দলে যখন প্রথম সুযোগ পায় সে, তখন বয়সে অনেক ছোট। কিন্তু দলের সবার সঙ্গে মানিয়ে নিতে কোনো সমস্যা হয়নি। সব সময়ই দেখেছি, ছোট-বড় সবার সমস্যায় সবার আগে উপস্থিত থাকতেন মাশরাফি। এ জন্যই আমি মনে করি তিনি দলের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেটার। তার আরেকটি গুণ হচ্ছে মাঠে এবং মাঠের বাইরে সব ক্রিকেটারের সঙ্গে তার আচরণ একই রকম। খোঁজখবর নেওয়ার বিষয়ে বাবাসুলভ একটি ভালোবাসা রয়েছে তার। ’
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে সফল ক্রিকেটারের নাম মাশরাফি। ২০০১ সালের নভেম্বরে জিম্বাবুয়ে সিরিজে অভিষেক মাশরাফির। এরপর থেকে জয়জয়কার। কিন্তু ইনজুরি বার বার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মাশরাফির ক্রিকেটের পথচলায়। অন্য কেউ হলে হয়তো থমকে দাঁড়াতেন। ব্যাট, প্যাড, বুট জোড়া তুলে রাখতেন। কিন্তু অদম্য মানসিকতার মাশরাফি লড়াই করে জয় করেছেন সব প্রতিকূলতাকে। সাত-সাতটি বড় অপারেশনের পরও তিনি দেশের এক নম্বর পেসার। সবচেয়ে সফল ক্রিকেটার। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেকের পর সদ্যসমাপ্ত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি পর্যন্ত ১৭৯ ওয়ানডে খেলে রান করেছেন ১৫৮৭ এবং উইকেট সংখ্যা ২৩২টি।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে একমাত্র ক্রিকেটার মাশরাফি, যিনি তিন তিনবার অধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। যা ক্রিকেট বিশ্বেও বিরল। ২০০৯ সালে প্রথম দলনায়ক হয়েছিলেন। ইনজুরিতে পড়ে সরে দাঁড়াতে হয় তখন। এরপর ২০১০ সালে ফের দায়িত্ব পান। এবারও ইনজুরি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এরপর সর্বশেষ ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে জিম্বাবুয়ে সিরিজে দায়িত্ব পান তৃতীয়বারের মতো। তখন থেকেই আমূল পাল্টে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। তার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কোয়ার্টার ফাইনাল, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলা ছাড়াও ঘরের মাটিতে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জয় এবং শ্রীলঙ্কার মাটিতে সিরিজ ড্র করেছে বাংলাদেশ। সবই হয়েছে টিম বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে এবং মাশরাফির ক্ষুরধার মস্তিষ্কের ব্যবহারে।
মাশরাফির নেতৃত্বে বাংলাদেশ সর্বশেষ ৪০ ওয়ানডের ২৪টিতে জিতেছে। তার ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সও কিন্তু সবাইকে ছাড়িয়ে। ৪০ ওয়ানডেতে উইকেট ৫৮টি। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের উইকেট ৪১ ম্যাচে ৫৩টি, মুস্তাফিজ ২২ ম্যাচে ৪৪ উইকেট। এমন পারফরম্যান্সের পরও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে বিসিবি। বিষয়টি হাস্যকর! বয়স বাড়ছে বলেই ভাবছে ক্রিকেট বোর্ড। কিন্তু মাশরাফির বেলায় বয়স নয়, তার ক্লাসটাকেই বড় করে দেখা উচিত বলে মনে করেন দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। এখন বিসিবি, কোচ চন্ডিকা হাতুরাসিংহে কী ভাবছেন, সেটাই দেখার বিষয়।