ফিরতে হবে ১০ লাখ প্রবাসীকে

Slider অর্থ ও বাণিজ্য

Bd-pratidin-08-07-17-F-01

 

 

 

 

 

মালয়েশিয়ায় সাঁড়াশি অভিযানে আটক দুই সহস্রাধিক, ইউরোপ-আমেরিকায় ধরপাকড় শেষ হয়ে আসছে সৌদি সাধারণ ক্ষমার তারিখ, বিপাকে আমিরাত-কাতার প্রবাসীরা

হঠাৎ করেই বিশ্বের কয়েকটি দেশে থাকা প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি কর্মী সংকটে পড়েছেন। এর বেশির ভাগেরই অবশ্য ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ বা ভিন্ন পদ্ধতিতে ওসব দেশে গিয়ে অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে মালয়েশিয়ায় প্রায় ৩ লাখ বাংলাদেশি যে কোনো মুহূর্তে গ্রেফতারের আতঙ্কে ভুগছেন। সৌদি আরবে কাজ হারানো ও গ্রেফতার হয়ে দেশে ফেরার শঙ্কা তৈরি হয়েছে ২ লক্ষাধিক বাংলাদেশির। বিশ্ব রাজনীতির মারপ্যাঁচে বিপাকে পড়েছেন কাতারে থাকা ৩ লাখ বাংলাদেশি। ভিসার সমস্যায় চরম সংকটে আছেন আরব আমিরাতে থাকা ৫ লক্ষাধিক বাংলাদেশি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে বসবাস করছেন বলে ৯৩ হাজার বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার চাপ কঠোর থেকে কঠোরতর করার চেষ্টা করছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। ইউরোপে যাওয়ার লোভে তুরস্ক গিয়ে পৌঁছানো ২ হাজার বাংলাদেশি সেখানে আছেন বন্দীদশায়। বিপত্সংকুল জেনেও ইউরোপে যাওয়ার আরেক পথ হিসেবে লিবিয়াকে বেছে নেওয়া কয়েক হাজার ভাগ্যান্বেষী রয়েছেন চতুর্মুখী শঙ্কায়। এমন পরিস্থিতিতে আগামী কয়েক বছরে সব মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশিকে দেশে ফিরতে হবে বলে মনে করছেন জনশক্তি রপ্তানিসংশ্লিষ্টরা। অভিবাসনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবৈধ পথে অদক্ষ কর্মীদের প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশে পাঠানোর পথ ধীরে ধীরে রুদ্ধ হয়ে আসছে। এদের ফিরিয়ে এনে বৈধ পথে নতুন কর্মী পাঠানোর সুপারিশও করছেন কেউ কেউ। জানা যায়, মালয়েশিয়ায় অবৈধ বিদেশি কর্মী ধরতে সরকারি অভিযান জোরদার। তাই সেখানে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে ৩ লাখ বাংলাদেশিকে। তারা কাজেও যেতে পারছেন না, বাসায়ও থাকতে পারছেন না। ৩০ জুন মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া এ সাঁড়াশি অভিযানে ইতিমধ্যেই ২ হাজার অবৈধ কর্মী গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেছেন। এখনো মালয়েশিয়ার অলিগলি, প্রতিটি শহর ও গ্রামে একযোগে অভিযান চালাচ্ছে সরকার। এতে বৈধ কাগজপত্র না থাকা বিদেশিরা আতঙ্কে রয়েছেন। এ অবৈধ বিদেশির তালিকার একটি বড় অংশ বাংলাদেশি। এখন মালয়েশিয়ার দেওয়া সুযোগ গ্রহণ করে জেল ছাড়াই দেশে ফিরে আসতে পারবেন বাংলাদেশিরা। জরিমানা দিয়ে এ সুযোগ গ্রহণ না করলে কারাগারে যেতে হতে পারে অবৈধভাবে অবস্থান করা কর্মীদের। সূত্রমতে, বর্তমানে ১৩ লাখ বাংলাদেশি সৌদি আরবে বিভিন্ন পেশায় কাজ করছেন। রয়েছেন ৬০ হাজার নারী গৃহকর্মী। এ হিসেবে সৌদি আরবই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। কিন্তু এখানেও কমপক্ষে ২ লাখ বাংলাদেশি রয়েছেন কাগজপত্রবিহীন বা অবৈধ। অবৈধদের বহিষ্কারে তৎপর সৌদি পুলিশ। পালিয়ে বেড়াতে হয় তাদের। সর্বশেষ ২৯ মার্চ থেকে তিন ধরনের অবৈধদের জন্য জেল-জরিমানা ছাড়া দেশে ফেরার সুযোগ দিয়েছে সৌদি সরকার। চলতি মাসেই শেষ হচ্ছে এ সুযোগ। এরপর সেখানেও চলবে সাঁড়াশি অভিযান। নদীর স্রোতের মতো সৌদি আরব যাওয়া বাংলাদেশির অনেকেই কোনো নির্দিষ্ট কাজ ছাড়াই ফ্রি ভিসার নামে ওমরাহ বা ট্যুরিস্ট ভিসায় থাকছেন দেশটিতে। তাদের অনেকেই ঘুরছেন রাস্তায় রাস্তায়। এখন নতুন করে অনেক প্রতারক এজেন্সি ভুয়া কোম্পানির নামে ভিসা ইস্যু করে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশিদের। আগামী মাসে অভিযান শুরু হলে এদের প্রত্যেকেই পড়বেন বিপাকে। দেশের তৃতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার কাতারে নতুন শ্রম আইন সংকটে ফেলেছে প্রায় ৩ লাখ বাংলাদেশিকে। এ আইনে বলা হয়েছে, অনুমতি ছাড়া কোনো শ্রমিককে নিয়োগদাতা অন্য কাজে লাগাতে পারবেন না। এ আইন অমান্য করলে ৫০ হাজার কাতার রিয়াল জরিমানা ও তিন বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এতে দেশটিতে অভিবাসী তার সুবিধামতো মালিক পরিবর্তন করতে পারছেন না। এদিকে কাতারের সঙ্গে সৌদি জোটের বেশ কয়েকটি দেশের সম্পর্ক ছিন্নের কারণে অনেক বাংলাদেশির মধ্যেই আতঙ্ক কাজ করছে। তারা মনে করছেন এতে তাদের ওপর প্রভাব পড়বে। তাদের চাকরিচ্যুত করা হতে পারে। অন্যদিকে, নতুন ভিসা ইস্যু না করা এবং ‘আকামা’ পরিবর্তনের সুযোগ না থাকায় চরম সংকটে আছেন আরব আমিরাতের বাংলাদেশিরা। তারা না পারছেন ফিরতে, না পারছেন নতুন কাজে যোগ দিতে। এক ধরনের মানবেতর জীবনযাপন করছেন আমিরাত প্রবাসীরা। অন্যদিকে, বিশ্বের পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিপাকে ফেলেছে ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোয় এত দিন নির্বিঘ্নে থাকা কাগজপত্রবিহীন বাংলাদেশিদের। অবৈধ অবস্থানকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ দেশে পাঠানোর নতুন অভিবাসন নীতি নিয়েছে ইউরোপ। ইইউ কর্মকর্তা বলছেন, ইউরোপের দেশগুলোয় কমপক্ষে ৯৩ হাজার অবৈধ বাংলাদেশি আছেন এবং বাংলাদেশকেই তাদের ফেরত আনতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন সরকার শুরু করেছে ধরপাকড়। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে কাগজপত্রবিহীন অবস্থান করা কমপক্ষে ২০ হাজার বাংলাদেশি সর্বদাই থাকছেন গ্রেফতার আতঙ্কে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) জাবেদ আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে বৈধ পথে অভিবাসনে বিশ্বাস করে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষরকারী বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। এর পরও কিছু প্রতারণার কারণে বাংলাদেশিরা অবৈধ হয়ে যাচ্ছেন। তাদের হয়তো ফিরতে হবে। তবে তারা যেন ফিরে আবার যেতে পারেন সে বিষয়ে ওই দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা আছে। এর ইতিবাচক সমাধানের বিষয়ে আমরা আশাবাদী। ’ তিনি জানান, বৈদেশিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতকরণ ও অভিবাসন ব্যবস্থাপনা খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যার অন্যতম হলো ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত কর্মীদের মধ্য থেকে শ্রমিক প্রেরণ। কোনো শ্রমিক নিবন্ধন না করে বিদেশ গেলে সরকার তার দায়দায়িত্ব নেবে না।

মালয়েশিয়ায় ৮০০ বাংলাদেশিসহ আটক ২ সহস্রাধিক : মালয়েশিয়ায় অব্যাহত সাঁড়াশি অভিযানে গত দুই দিনে বাংলাদেশিসহ ২ শতাধিক অবৈধ শ্রমিক আটক করেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ। কুয়ালালামপুর ও এর আশপাশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। ৩০ জুন মধ্যরাতে শুরু হওয়া এ অভিযানে গতকাল পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ৭০০ অবৈধ শ্রমিক আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮০০-এরও অধিক বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছেন। তবে ১ থেকে ৫ জুলাই পর্যন্ত ৭০৩ জন বাংলাদেশি শ্রমিক আটক হয়েছেন বলে হাইকমিশনসূত্রে জানা গেছে। দেশটির অভিবাসন বিভাগের মহাপরিচালক মুস্তাফার আলী বলেন, ১৫ ফেব্রুয়ারি অবৈধ শ্রমিকদের নিবন্ধন শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত তারা ৪০টি ভুয়া ই-কার্ডের সন্ধান পেয়েছেন। তথাকথিত যেসব এজেন্ট ভুয়া ই-কার্ড ইস্যুর উদ্যোগ নিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একজন বাংলাদেশিকে আটক করা হয়েছে। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৮টি ভুয়া ই-কার্ড। মুস্তাফার আলী আরও বলেন, ভুয়া ই-কার্ড দেখতে হয়তো একই রকম। কিন্তু এতে যে কুইক রেসপন্স কোড (কিউআর) আছে তা নকল করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া আঙুলের ছাপ, আসল-নকল পদ্ধতি ইমিগ্রেশনে রয়েছে। দেশটির জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অভিবাসন কর্তৃপক্ষ কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ঘোষণা করার পর সর্বশেষ ২৬ হাজার ৯৫৭ নিয়োগকর্তার মাধ্যমে প্রায় আড়াই লাখ অবৈধ কর্মী ই-কার্ডের আবেদন করেন। ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৪৬ জনের ই-কার্ড করা হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ২৩ শতাংশ। ইমিগ্রেশন বিভাগ ৬ লাখ ই-কার্ড করার আশা করেছিল। লক্ষ্য পূরণে ১ জুলাই থেকে নিয়োগকর্তা ও অবৈধ কর্মীদের গ্রেফতার এবং শাস্তির জন্য কাজ শুরু করেছে ইমিগ্রেশন বিভাগ। তিনি আরও বলেন, অবৈধ কর্মীদের জন্য নতুন করে ‘থ্রি প্লাস ওয়ান’ পদ্ধতিতে দেশে ফেরার সুযোগ করে দিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। এ পদ্ধতিতে যে কোনো অবৈধ বিদেশি শ্রমিক ৪০০ রিঙ্গিত জরিমানা এবং কুয়ালালামপুর-ঢাকা বিমানের টিকিট নিয়ে পুত্রাজায়ার ইমিগ্রেশনে গেলেই দেশে ফেরার জন্য সুযোগ দেওয়া হবে। তবে ফ্রি প্লাস ওয়ান পদ্ধতি কত দিন থাকবে তা জানা যায়নি। এ অবস্থায় আতঙ্কিত না হয়ে বৈধ হওয়ার সুযোগ নিতে হাইকমিশনে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এ অভিযানে শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে ইমেজ সংকটেও পড়ছেন প্রবাসীরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *